জিআই পণ্যের ডকুমেন্টেশনে যা থাকা দরকার
ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্যের আবেদন করার জন্য ডকুমেন্টশন জমা দেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি শর্ত। ডকুমেন্টেশনের মাধ্যমে একটি সম্ভাব্য জিআই পণ্যের প্রাথমিক সকল প্রকার যাচাই বাছাই করা হয়। তাই জিআই পণ্যের ডকুমেন্টেশন তৈরিতে কয়েকটি দিক বিশেষ গুরুত্বের সাথে উপস্থান করা যেতে পারে। জিআই পণ্যের ডকুমেন্টেশনে যা থাকা দরকার তা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে এখানে। শুরুতে একটি চেকলিস্ট করা যেতে পারে।
ডকুমেন্টেশন চেকলিস্ট
পণ্যের নাম
জিআই পণ্যের ডকুমেন্টেশন তৈরিতে প্রথমে একটি সম্ভাব্য জিআই পণ্যের নাম উল্লেখ করতে হয়। খুবই আন্তরিকতা ও সতর্কতার সাথে নাম নির্ধারণ করা আবশ্যক। নতুবা কি পরিমাণ অসুবিধা হতে পারে তা ”টাঙ্গাইল শাড়ি অফ বেঙ্গল” এর কথা স্মরণ করলে উপলব্ধি করা যাবে।
সাধারণত স্থানের নামের সাথে মিল রেখে সম্ভাব্য জিআই পণ্যের নামকরণ হয়। যা পূর্ব থেকেই এই নামে পরিচিত। যেমন, কুমিল্লার রসমালাই, টাঙ্গাইলের চমচম, ঢাকাই মসলিন ইত্যাদি। তবে কিছু নাম জেনেরিক নামেই পরিচিত তাই সেই নামেই জিআই স্বীকৃতির আবেদন করা হয়। যেমন: জামদানি শাড়ি।
নোট: সাধারণত, মানুষের কাছে যে নামে পণ্যটি পরিচিত সে নামে নামকরণ করা হয়।
স্পেসিফিকেশন
জিআই পণ্যের ডকুমেন্টেশন তৈরিতে স্পেসিফিকেশন খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। একটি পণ্যকে আলাদা ও সুস্পষ্টভাবে চিনতে সাহায্য করে স্পেসিফিকেশন। পণ্যের এমন কিছু বৈশিষ্ট্যকে উপস্থাপন করে যা সমজাতীয় পণ্য থেকে আলাদা ভাবে চিনতে সাহায্য করে। যেমন: চমচম সারাদেশে উৎপাদন হয়। এর মধ্যে রাজবাড়ির চমচমেরও বিশেষ খ্যাতি রয়েছে। কিন্তু টাঙ্গাইলের চমচমের স্বাদ ও বৈশিষ্ট্য অন্য যেকোন চমচমের থেকে আলাদা। সেই আলাদা হওয়ার বিষয়গুলো অল্প কথার মাধ্যমে উপস্থাপন করে জিআই পণ্যের পরিক্ষকের মনে একটি ছবি এঁকে দেওয়া কিংবা তাকে ভাবনার খোড়াক দেওয়াই স্পেসিফিকেশনের লক্ষ্য।
স্পেসিফিকেশনে যে বিষয়গুলো থাকতে পারে,
- এই পণ্যের আকৃতি কেমন?
- স্বাদ কেমন?
- কোন সময় কোন রূপে থাকে?
- অন্য পণ্য থেকে কেন আলাদা? সেই আলাদা হওয়ার দিকগুলো কি ইত্যাদি।
শ্রেণি নির্ধারণ
আন্তর্জাতিক শ্রেণিবিন্যাস অনুসারে পণ্যটি কোন শ্রেণির অধিভুক্ত তা আবেদন পত্রে উল্লেখ করার পাশাপাশি ডকুমেন্টেশনেও রাখা যেতে পারে। জিআই পণ্যের শ্রেণি নির্ধারণ পদ্ধতি বর্ণনা করা হয়েছে।
জিআই পণ্যের বর্ণনা
ইতিহাস সহ সম্ভাব্য জিআই পণ্যের সার্বিক দিক অন্তর্ভুক্ত করে একটি বর্ণনা লিখতে হয়। তা ৬০০-১০০০ শব্দের মধ্যে লিখলে স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে ধরা যেতে পারে। তবে বর্ণনা আরও বড় কিংবা ছোট হলেও অসুবিধা নেই।
বর্ণনা অংশে বেসিক বিষয়গুলো সহ যে বিষয়গুলো আসতে পারে, পণ্যের পরিচিতি, বৈশিষ্ট্য, অর্থনৈতিকগুরুত্ব, ভৌগোলিক বিশেষত্ব, সাংস্কৃতিক সংযুক্তি ইত্যাদি। অর্থাৎ এই অংশটিকে বলা যেতে পারে পণ্যের ওভারভিউ। একটি পণ্যের সার্বিক দিক উঠে আসবে বর্ণনা অংশে।
উৎপাদন ও বাণিজ্যিক এলাকার মানচিত্র
একটি ভৌগোলিক পণ্যের অন্যতম শর্ত হচ্ছে পণ্যটি নির্দিষ্ট একটি অঞ্চলের স্পেশাল পণ্য। যা সর্বত্র উৎপাদন হলেও সেই নির্দিষ্ট এলাকার পণ্যই গুণেমাণে সেরা। তা হতে পারে কারিগরি দক্ষতার কারণে কিংবা উপাদানের কারণে অথবা স্থানীয় জলবায়ুর প্রভাবে। তা সামান্য বর্ণনা দেওয়ার পাশাপাশি মানচিত্র প্রদানের মাধ্যমে সুস্পষ্ট করতে হয়।
বাণিজ্যিক এলাকার মানচিত্র থাকাও আবশ্যক। অর্থাৎ এই পণ্যটি বিক্রয়ের স্থানগুলো। তা দেশের কোন কোন অঞ্চলে বিক্রি হয়? কোন কোন দেশে যায় তা বর্ণনা করা সহ মানচিত্রের মাধ্যমে পরিষ্কার ধারণা দিতে হয়। অর্থাৎ প্রতিটি পণ্যের জন্য উৎপাদন ও বাণিজ্যিক এলাকার মানচিত্র দেওয়া আবশ্যক।
নোট: উভয় মানচিত্র সত্যায়িত করে ডিপিডিটিতে জমা দিতে হয়।
উৎসের প্রমাণ
জিআই পণ্যের ডকুমেন্টেশন তৈরি ও আবেদন করার জন্য উৎসের প্রমাণ থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি শর্ত। অর্থাৎ পণ্যটি কোথায় উৎপাদন হয়? কবে থেকে উৎপাদন হয়ে আসছে তার প্রাচীন দলীল সংগ্রহ করতে হয়। এর জন্য সাহিত্য তথা কবিতা, গান, উপন্যাস কিংবা গল্প দারুণ অবদান রাখতে পারে। এছাড়াও জেলা গেজেটিয়ার, সাহিত্য, পত্রিকা, ম্যাগাজিন বা অন্য যেকোনভাবে উৎসের প্রমাণ সংগ্রহ করা যেতে পারে। লিখিত প্রমাণ থাকা উত্তম। তবে অন্যান্য নিদর্শনও গ্রহণযোগ্য হতে পারে।
নোট:
- কমপক্ষে ৫০ বছরের ইতিহাসের রেফারেন্স থাকলে বিষয়টি শক্তিশালী হয়।
- জিআই পণ্যের ডকুমেন্টেশনে উৎসের প্রমাণ উল্লেখ করা সহ ৫ কপি আবেদন পত্রের সাথে ডিপিডিটিতে প্রেরণ করতে হয়।
উৎপাদনের পদ্ধতি
প্রস্তাবিত পণ্যটি কোথায় উৎপাদন হয়? কিভাবে উৎপাদন হয়? কি কি কাঁচামাল ব্যবহার করা হয়? তা কিভাবে বা কোথায় থেকে সংগ্রহ করা হয়? পণ্যটি বিশেষ হওয়ার পিছনের উৎপাদন পদ্ধতি কিংবা কাঁচামালের প্রভাব আছে কিনা তা যতটা সম্ভব্য নির্ভুল দেওয়া আবশ্যক। উৎপাদন প্রক্রিয়া লিখিত আকারে দেওয়ার পাশাপাশি তা ছবির মাধ্যমে উপস্থাপন করা যেতে পারে। অর্থাৎ পণ্যের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি ধাপই উঠে আসবে এই উৎপাদন পদ্ধতির ছবিগুলোর মাধ্যমে।
অনন্য বৈশিষ্ট্য
চমচম এমন একটি মিষ্টি তা সারাদেশে উৎপাদন হয়। তারপরও পণ্যটি কেন টাঙ্গাইলের খ্যাতি অর্জন করেছে এবং যুগযুগ ধরে এই সুনাম ধরে রেখেছে তার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যগুলো উল্লেখ করা আবশ্যক। অনন্য বৈশিষ্ট্য সঠিকভাবে উল্লেখ করার মাধ্যমে সমজাতীয় অন্য সব অঞ্চলের পণ্য থেকে এই পণ্যটিকে আলাদা করে দেয়। তাই সুস্পষ্টভাবে অনন্য বৈশিষ্ট্যগুলো উপস্থাপন করা আবশ্যক।
অন্যান্য
উপরের শর্তগুলো প্রতিটি পণ্যের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তবে পণ্য অনুযায়ী জিআই পণ্যের ডকুমেন্টেশনে কিছু ব্যতীক্রম থাকতে পারে। তাই ”অন্যান্য” অংশে তা উল্লেখ করে দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এছাড়াও অন্যান্য অংশে পণ্যের বিশেষ ছবি, পণ্য সংশ্লিষ্ট ছবি, উৎপাদনকারীদের তালিকা, রেফারেন্স, পরিদর্শন কর্তৃপক্ষ, বৈজ্ঞানিক প্রতিবেদন, পণ্যের উৎপাদনকাল ইত্যাদি বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ রয়েছে। অর্থাৎ সম্ভাব্য জিআই পণ্য হিসেবে সহায়ক যেকোন কিছুই এখানে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
পরিশেষে, বলা যেতে পারে একটি শক্তিশালী ডকুমেন্টশন প্রদানের মাধ্যমে একটি পণ্যকে জিআই স্বীকৃতি অর্জনে এগিয়ে রাখতে পারে। ডকুমেন্টেশন যত ভালো হবে পণ্যটি তত দ্রুত জিআই স্বীকৃতি অর্জনের জন্য মনোনিত হতে পারে। জিআই পণ্যের ডকুমেন্টেশন তৈরি করতে সাধারণত যে বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করতে হয় তার আলোচনা হয়েছে এই আর্টিকেলে। এছাড়াও ডিপিডিটির ওয়েবসাইটে থাকা জার্নালগুলো পড়ে নেওয়ার মাধ্যমে ডকুমেন্টেশন তৈরির ধারণা পাওয়া যাবে।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, আওয়ার শেরপুর।
মনের মধ্যে থাকা সব প্রশ্নের উত্তর পেয়েছি।
জেনে ভালো লেগেছে। ধন্যবাদ