আমরা আমাদের চারপাশে বিভিন্ন ধরনের পোশাক এর সমারোহ দেখতে পাই৷ বাংলাদেশী হিসেবে পোশাক শিল্প আমাদের গর্বের জায়গা এবং আমরা আশেপাশে সবথেকে বেশি এই পোশাকটি ই দেখি যা সবথেকে বেশিই ব্যবহার হয় প্রতিদিন। অফিস-আদালত, স্কুল কলেজ প্রাইভেট, আত্মীয়র বাসা এমনকি বাজার বা প্রাত্যাহিক জীবনের দৌড়াদৌড়ি সবকিছুতেই আমাদের সঙ্গী সালোয়ার কামিজ৷
তবে যত যা ই বলি, যত বহুল ব্যবহার ই হোক এই পোশাকটি র দেশীয় আমেজ এই পোশাকটি কে ছুঁয়ে যায় খুব কম। দেশীয় সালোয়ার কামিজ পরলেও আমরা ভীনদেশী সালোয়ার কামিজ কে ই মনে হয় যেন মনে বসিয়ে রেখেছি সেরার তকমা টি দেয়ার জন্য, আর তাইতো দেশে উৎপাদিত অসংখ্য ভালোমানের সালোয়ার কামিজ ও সেরার জায়গাগুলোতে নিজেদের অবস্থান নিশ্চিত করতে পারেনি। দায়ভার কেউ না নিলেও আমাদের দেশীয় সালোয়ার কামিজ নিয়ে প্রচারণার অভাব ই এর মূল কারণ। কেননা প্রচারণার লক্ষ্যে যখন ই-কমার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ এর প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি রাজিব আহমেদ থ্রিপিস নিয়ে বলা শুরু করলেন এরপর ই আমরা এই ২০২২ সালে এসে দেখলাম এবং জানলাম আমাদের দেশীয় ভালোমানের সব থ্রিপিস নিয়ে এবং বুঝতে পারলাম যে এই সেক্টর সম্ভাবনায় পরিপূর্ণ, শুধু আমাদের এগিয়ে আসতে হবে।
আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে?
তোমার ছেলে উঠলে গো মা রাত পোহাবে তবে….
কাজী নজরুল ইসলাম এর, খোকার সাধ কবিতার এ চয়নগুলোর মত ই বলতে হয় যে আমাদের থ্রিপিস এর এ সেক্টর কে এগিয়ে নিয়ে আমাদের ই জাগতে হবে, আমাদের কাজ করতে হবে, প্রচার করতে হবে, তবেই না আমরা এমন সম্ভাবনাময় দেশীয় সেরা একটি সেকটর কে পুরো বিশ্বের বুকে তুলে ধরতে পারবো এবং সবার গ্রহণযোগ্যতা ও পাবে।।।
এখন একটা প্রসঙ্গ ই আগে ক্লিয়ার করে নেই যে, থ্রিপিস নাকি সালোয়ার কামিজ?
আসলে ভুল নয় কোনটা ই৷ কেননা একচুয়ালি পরিধেয় এ বস্ত্রের নাম সালোয়ার কামিজ হলেও এর সাথে মূলত আমাদের দেশে ওরনা ক্যারী করা হয় এবং তিনটি আলাদা এ টুকরা আমাদের সমাজে থ্রিপিস হিসেবে ই সমাদৃত৷ সালোয়ার কামিজ এবং ওরনা মিলেই শুধু থ্রিপিস হয় এমনটা না, যেকোন তিনটা কাপড়ের সমষ্টি ই থ্রিপিস হতে পারে যেমন ইদানীং মেয়েরা সালোয়ার কামিজ এর সাথে কোটি পরে এটাও কিন্তু থ্রিপিস৷ ইভেন ওয়ান পিস, টু পিস, থ্রিপিস, ফোরপিস ডিজাইন ভেদে এর নাম এর ধরণ পালটে গেলেও আমাদের দেশে আমরা যেখানেই যাই, কোন শপিং সেন্টার বা কোন মার্কেট এর নরমাল দোকান সবখানে থ্রিপিস হিসেবেই আমরা এই টার্ম টা ব্যবহার করে থাকি তাই পুরো আর্টিকেল এ আমি থ্রিপিস হিসেবেই কনটিনিউ করবো।
কোথা থেকে আসলো সালোয়ার কামিজ/থ্রিপিস?
একেবারে প্রাচীনকাল বা তার ও পরে কোথাও সালোয়ার কামিজের দেখা মেলেনি, এমনকি চর্যাপদ এ ও এ পোশাকের কোন বর্ণনা পাওয়া যায়নি তাহলে বাংগালীয়ানায় এ পোশাক যোগ হলো কিভাবে, শুরু টার সেই শুরু ই বা কোথায়?
অনেকের মতে পারস্যে, অনেকের দাবী পাঞ্জাবে। কিংবা সেই মংগোল যুগ।
সেই সময় সালোয়ার কামিজ কে মুসলিম পোশাক হিসেবে বিবেচনা করা হতো। দ্বাদশ শতাব্দীতে তিমুরিড আক্রমন করে উপমহাদেশে, তিমুরিড হলো তুরস্ক মংগোলসের মুসলিম রাজবংশ, যারা সাথে করে যাযাবর পোশাক হিসেবে নিয়ে আসে এরকম হাবভাবের পোশাক। যা পরে মুঘল সাম্রাজ্যে আরো মোডিফাই হয়।। তৈমুরিদের বংশধর রাই প্রতিষ্ঠা করেছিলো মুঘল সাম্রাজ্য। মুঘল সাম্রাজ্য কে বলা হয় টেক্সটাইল কারুশিল্পের স্বর্ণযুগ।
সেই সময়ে নারীদের পোশাক ছিলো কোমরের উপর একটু আটসাট করে ফিটিং করা যা এখন আমাদের লং গাউন, আনারকলী এসবের সাথে মিলে যা এবং তখন তারা এই পোশাকের সাথে ওড়না ও ব্যবহার করতো। প্রথম দিকে রাজ কাজে বাদশাহের পরিবারে এসব পোশাক পরিধান করা হলেও পরবর্তীতে অভিজাত পরিবারে এবং ত্রা ও পরে গ্রামের ধনীদের এসব পোশাক পরতে দেখা যায়। এরপর ধীরে ধীরে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষরা এসব পরিধান করা শুরু করে। সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়ে সালোয়ার কামিজ বর্তমান রূপ পেয়েছে।।।
ব্রিটিশ শাসনামলে অভিজাত মুসলমানদের মধ্যে যারা ছিলেন উর্দুভাষী, তারা ই নরমালি সালোয়ার কামিজ পরতেন। তাছাড়া কেউ ই এ পোশাকে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেনি।
কিনতু পরবর্তীতে সময়ের পরিক্রমায় মুসলিম নারীরা সহ হিন্দু নারীরা সবাই সালোয়ার কামিজ পরা শুরু করে।।
আর এখন তো বলার অপেক্ষা রাখেনা যে শিশু, কিশোর, তরুণী, মহিলা, বৃদ্ধা সহ সব শ্রেণী পেশার নারীরা সালোয়ার কামিজ/ থ্রিপিস পরিধান করে।
নব্বই দশকের পর থেকে অনেক উন্নতি সাধন হয়েছে পোশাকে আমাদের দেশে৷ ফ্যাশন জগতে অনেক পরিবর্তন ও এসেছে। থ্রিপিস এর ব্যবহার বেড়েছে সর্বত্র ই৷ বিভিন্ন ধরনের গজ কাপড় দিয়ে বিভিন্ন ভাবে থ্রিপিস ব্যবহার দেখা যায় অনেক আগে থেকেই কিন্তু আমাদের দেশে শুধু গজ কাপড় না আরো নানা ধরনের কাপড়ের, ডিজাইন এর থ্রিপিস আছে যার সঠিক সংখ্যা বা সমীকরণ কোথাও নেই৷ তবে নিজের জানার আগ্রহ থেকে যখন খুঁজতে শুরু করলাম তখন নিজের গন্ডিতেই এত থ্রিপিস কে পেয়ে গেলাম যা সত্যিই একদিকে যেমন ভালোলাগার অন্যদিকে অবশ্যই আমাদের জন্য গর্বের জায়গা৷ এমন কিছু থ্রিপিস এর নাম এখানে তুলে ধরছিঃ
১. অর্ক সেঞ্চুরি কাপড়ের উপর ব্লক বা কাজ করা
২. আনারকলি
৩. আড়ি এমব্রয়ডারি
৪. আড়ি ওয়ার্ক
৫. ইয়োক বসানো
৬. এন্ডিকটন
৭. এপ্লিক
৮. এমবি কটন
৯. এম্বুশ করা
১০. এসি কটন
১১. ওয়াংলাই
১২. ওয়ানক্লাই
১৩. কা-জামপিন
১৪. কাটওয়াক
১৫. কাতান
১৬. কাঁথা স্টীচ
১৭. কারচুপি
১৮. কালামকারি থ্রিপিস
১৯. কেমিক্যাল ডাই বাটিক থ্রিপিছ টার্সেল লাগানো থাকলে টার্সেল বাটিক থ্রিপিস
২০. কোটা সুতিতে কাজ করা
২১. কটকি থ্রিপিস
২২. কুষ্টিয়ার তাঁত এর থ্রিপিস
২৩. খাদি
২৪. খেশ
২৫. গাউন সালোয়ার
২৬. গুজরাটি কাজ
২৭. গ্যাস কটন থ্রিপিছ
২৮. গ্রামীণ চেক
২৯. চায়না ভয়েল এ কাজ করা
৩০. চুন্দ্রি বাটিক
৩১. চুমকি
৩২. জামদানী প্রিন্ট
৩৩. জামদানী ভিসকোস থ্রিপিস
৩৪. জামদানী মোটিফ এ ব্লক
৩৫. জামদানী মোটিফ হাতের কাজ
৩৬. জর্জেট
৩৭. জলছাপ মিনাকারি থ্রিপিস
৩৮. জয়পুরী
৩৯ জুট কাতান এর থ্রিপিস
৪০. টাই-ডাই
৪১. টিস্যু কাপড়ে থ্রিপিস এমব্রয়ডারি করা বা বিভিন্ন কাজ
৪২. ডিজিটাল প্রিন্ট
৪৩. ডবি ফেব্রিকস
৪৪ তাঁত এর সুতি থ্রিপিছ
৪৫. তুলা বাটিক
৪৬. তসর
৪৭. তসর সিল্ক
৪৮. থামি
৪৯. দকমান্দা
৫০. ধুপিয়ান
৫১. নাফিই
৫২. নিব কটন জামদানী থ্রিপিস
৫৩. নেট ম্যাটেরিয়াল এর থ্রিপিস
৫৪. পাটের থ্রিপিছ
৫৫. . পানচি ও পাড়হান
৫৬. পিনন হাদি
৫৭. পিয়ানি কটন
৫৮. প্যাচওয়ার্ক
৫৯. প্যাটেল কটন
৬০. প্যানেল জামদানী থ্রিপিস
৬১. পপলিন
৬২. ফুরিত-ফানেক-ফিদপু
৬৩. . ফ্লোরাল প্রিন্ট
৬৪. বাটিক
৬৫. বার্মিজ তাঁত
৬৬. বিভিন্ন জিনিসে ডলার বসানো
৬৭. বিভিন্ন ম্যাটেরিয়াল এ এমব্রয়ডারি
৬৮. বিশাল জর্জেট
৬৯. বেক্সি ভয়েল এ প্রিন্ট বা অন্যান্য কাজের থ্রিপিছ
৭০. বেনারসি
৭১. বেলকুচি তাঁত এর থ্রিপিছ
৭২. ব্লক
৭৩. ভেজিটেবল ডাই
৭৪. ভয়েল কাপড়ের থ্রিপিস
৭৫. ভয়েল প্রিন্ট
৭৬. মাসলাইস সুতার পিনন হাদি
৭৭. মাসলাইস সুতি থ্রিপিছ
৭৮. মাহেরশরি কটন
৭৯. মানিকগঞ্জ এর তাঁত এর থ্রিপিস
৮০. মোম বাটিক
৮১. মনিপুরি থ্রিপিছ
৮২. মসলিন
৮৩. মসলিন জামদানী
৮৪. রাজধানী ভয়েল এ স্কিনপ্রিন্ট
৮৫. রিনাই
৮৬. রিশিকা সিল্ক
৮৭. রিসা
৮৮. রেয়ন কটন
৮৯. লাখনৌ মোটিভ হাতের কাজ
৯০. লিনেন
৯১. লেইজ
৯২. লন
৯৩. শিপন জর্জেট
৯৪. স্ক্রিনপ্রিন্ট
৯৫. সাংঘাই ভয়েল
৯৬. সারারা ড্রেস
৯৭সার্টিন কাপড়ের থ্রিপিস
৯৮. সিকুয়েন্স ওয়ার্ক এর থ্রিপিছ
৯৯. সিল্ক
১০০. সিল্ক এ হাতের কাজ
১০১. সিল্ক এ হ্যান্ডপেইন্ট
১০২. স্টোন ওয়ার্ক
১০৩. সুতি প্রিন্ট
১০৪. সুদান জামদানী থ্রিপিস
১০৫. স্বপ্নপুরী জামদানী থ্রিপিস
১০৬. স্ল্যাব কটন
১০৭. হাতের কাজ
১০৮. হাফসিল্ক চুমকি জামদানী থ্রিপিস
১০৯. হাফসিল্ক জামদানী থ্রিপিছ
১১০. হ্যান্ডপেইন্ট
বহুল ব্যবহৃত এবং সম্ভাবনাময় কিছু থ্রিপিস তুলে ধরবো এই আর্টিকেল এর মাধ্যমে।
প্রথমেই তাঁত এর থ্রিপিস দিয়েই শুরু করিঃ
টাঙ্গাইল তাঁত এর থ্রিপিসঃ
টাঙ্গাইল তাঁত বা যেকোন তাঁত এর থ্রিপিস নিয়ে আমরা একটা ধারণাকে পোষণ করতাম যে তাঁতের থ্রিপিস সুতি হবে, প্রাইস তো একেবারেই রিজনাবল হবে, সব ঘরে ব্যবহার করার মত & ধুইলে ত্যানা হয়ে যাবে। এর বাহিরে তাঁত এর থ্রিপিস এর ভ্যারিয়েশন হতে পারে, তাঁত এর থ্রিপিস আমাদের সমাজে সমাদৃত হতে পারে এবং তাঁত এর থ্রিপিস এর ই আলাদা একটা ভ্যালু ক্রিয়েট হতে পারে এসব আমরা ভাবিইনি কখনো। কিন্তু দিন বদলের সাথে তাঁত এর থ্রিপিস এমন জায়গাতেই এসেছে। সেরা মানের সেরা কোয়ালিটির তাঁত এর থ্রিপিস এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি। ঘরে থেকে বাহিরে, শুধু বাহির না বরং বিভিন্ন প্রোগ্রাম, বিয়ে বাড়ি, পার্টি সহ সর্বত্র তাঁত এর থ্রিপিস পৌঁছে গেছে। তাঁত মানে এখন আর সুতি না, তাঁত এ হয় হাফসিল্ক জামদানী, সিল্ক জামদানী, সুতি জামদানী, মাসলাইস সুতি, নিব কটন, কটকি থ্রিপিস সহ অন্যান্য অনেক কিছুই৷ সব ই টাঙ্গাইল এর তাঁত এ পাই আমরা।
টাঙ্গাইল এর সুতি থ্রিপিস এর মাঝেও ক্যাটাগরি আছে। জামদানী সুতি গুলোর সুতায় আগে পাড়ি দিয়ে নেয়া হয়, অর্থাৎ মাড় দেয়া হয়। পাড়ি দেয়া ছাড়া তাঁত এ সুতা টানটান থাকেনা, তবে এগুলো খসখসে ভাব আসেনা এবং ব্যবহার এর সাথে সাথে আরো নরম ও সফট হয়৷ সুতি জামদানী থ্রিপিস এর সুতা গুলো ও আসে বাহির থেকে , বেশিরভাগ সুতি জামদানী গুলো ই মেশিনলুম এ তৈরি হয়৷ অত্যন্ত সুন্দর এবং দারুণ ফিনিশিং এর এ থ্রিপিস গুলো ইতিমধ্যে গ্রাহকদের মনে জায়গা করে নিয়েছে।
সুতির মাঝে নিব কটন এর সুতি ও আছে, যা সুতি হলেও ঝর্ণার মত সুতার ছিটেফোটা সারা জামায় ছুঁয়ে যায়৷ খুব সুন্দর দেখতে লাগে এগুলোকে।
কটকি থ্রিপিস এর কথা তো বলার অপেক্ষা ই রাখেনা৷ সুতি সুতা, মাসলাইস সুতা বিভিন্নভাবেই তৈরি হয় থ্রিপিস এর ক্ষেত্রে৷ জনপ্রিয়তার শীর্ষে বললেও ভুল হবেনা এগুলো৷ কটকি নকশা টা তে ই মেয়েদের ভালোলাগা মিশে আছে৷
কটকি অর্থ রং।। রং করার মাঝেই এর সৌন্দর্যের কারুকাজ। তাইতো এর নাম কটকি। মূলত রং করার সময় এই সুতা গুলো ডায়িং করা হয়। সব সুতা গুলোকে দুই ইঞ্চি গ্যাপ রেখে কস্টেপ দিয়ে বেধে নির্দিষ্ট রং এ চুবানো হয়। পরে শুকানোর পর কস্টেপ খুলে দেয়া হয়। এ কারণে কটকি তে সামান্য সাদার ছোয়া থাকেই। এর আরেকটি মূল বৈশিষ্ট্য টেম্পল মোটিভ।
সম্পূর্ণ তাঁতীদের হাতে এর পুরো প্রসেসিং, ম্যাটেরিয়াল জন্য কস্টিং অন্যান্য সুতির থেকে বেশি পরে যায়। কেননা জামা ওড়না আলাদা ভাবে, আলাদা রং এ, সম্পূর্ণ আলাদা মোটিভ এ করা হয়। এ কারণে প্রাইস টা সামান্য বেশি হয়।। প্রাইস এর থেকে ও বড় কথা এত সুন্দর থ্রিপিছ গুলো আমাদের দেশী।
কার্পাস তুলা কে মার্সেরাইজড পদ্ধতিতে প্রসেস করে এই মাসলাইস কটন সুতা তৈরি, যার কারণে এটি এত্ত বেশি সফট।। এই পদ্ধতিতে প্রসেস এর সময় ই সুতার ডায়িং করা হয়, যার কারণে রং ও পাকা হয়।। এই মাসলাইস কটন এর থ্রিপিস ও হয় টাঙ্গাইল এর তাঁত এ। সুতার অতীব সফটনেস এর কারণে হালকা মাড় দিলেও জামায় তার বিন্দু পরিমাণ রেশ থাকে না।। বরং আরো গ্লেসি হয়।।। এত আরামদায়ক এ থ্রিপিসগুলো যে ব্যবহারকারীদের প্রচুর প্রশংসা কুড়ায় এগুলো।
মাসলাইস কটন এর পাশাপাশি আরেক ধরনের থ্রিপিস আছে টাঙ্গাইল এ যা হলো গ্যাস সুতি সুতার গ্যাস কটন জামদানী থ্রিপিস। এগুলো ও অত্যন্ত নরম এবং আরামদায়ক। এত সফট যে এগুলোকে ভাজ করতে ইস্ত্রি করার প্রয়োজন হয়না, হাতের তালুতে মেসেজ করলেও সোজা হয়ে যায় ইস্ত্রি করার মত৷
শুধু সুতি না, সুতি ম্যাটেরিয়াল এর মাঝে এত এত ভ্যারিয়েশন থাকলেও জনপ্রিয়তার শীর্ষে আছে হাফসিল্ক সুতার টাঙ্গাইল এর হাফসিল্ক জামদানী থ্রিপিস। হাফসিল্ক এর সাদা ত্যানা কিনে এতে প্রথমে রঙ করে তাঁত এর সাথে জড়িত এক কমিউনিটি, যারা বেশিরভাগ এই রঙ করার কাজেই নিয়োজিত থাকে। এরপর যে ডিজাইন এ থ্রিপিস হবে তা তোলা হয় কাগজে, ডিজাইনার এর সাথে চুক্তি করে বিভিন্ন প্যাটার্ন এ করা হয় ডিজাইন এবং তাঁত এ তোলা হয়। এরপর তাঁত এ সুতা তুলে তৈরি হয় রঙ বেরং এর, বিভিন্ন ডিজাইন এর থ্রিপিস। এই থ্রিপিস আমাদের তাঁত এর বড় একটা অংশ দখল করে ফেলছে এর জনপ্রিয়তা নিয়ে আলহামদুলিল্লাহ।
এছাড়াও গ্রামীণ চেক এর ঐতিহ্যবাহী থ্রিপিস তো আছেই, সাথে আছে সুতি রেগুলার ইউজ এর থ্রিপিস সহ নানান কিছু৷
নারায়ণগঞ্জ এর তাঁত এর থ্রিপিসঃ
নারায়ণগঞ্জ আমাদের জামদানীর রাজ্য। এখানের জামদানী শাড়ি সারা বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সসংস্কৃতির সাথে মিশে আছে জামদানী৷ জামদানী পল্লী তে শাড়ি ই শুধু একমাত্র পণ্য না৷ এখানের থ্রিপিস, ওয়ানপিস, টুপিস সবকিছুই এখন উঠে আসছে বিশেষ করে ই-কমার্স এর হাত ধরে৷ গ্রাহক সন্তুষ্টি এবং চাহিদা সব মিলিয়ে জামদানী এই থ্রিপিস এর ইন্ডাস্ট্রি এগিয়ে যাচ্ছে খুব দ্রুতগতিতে৷
এখানের তাঁতীরা সুতি, রেশম, লাইলন, পলিস্টার এই চার ধরনের সুতা ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের থ্রিপিস বুনে থাকেন৷ এখানে পিউর সুতি, হাফসিল্ক, পিসি কটন, তসর কটন, মাসলাইস কটন এর থ্রিপিস, টুপিস, ওয়ান পিস হয়৷ পিউর সুতি থ্রিপিস এর ক্ষেত্রে বাইন ও তানা সুই জায়গাতেই সুতি সুতা তোলা হয় তাঁত এর এক্ষেত্রে থ্রিপিস শতভাগ সুতি সুতার হয় এবং সুতি ও পলিস্টার মিলিয়ে ও হয়৷
জামদানী র মত করেই বিভিন্ন কোয়ালিটি র ই থ্রিপিস হয়, ক্রেতা সাধ্য, পছন্দ মিলিয়ে নিজেদের প্রেফারেন্স এর উপর ই থ্রিপিস সেলেক্ট করা সম্ভব হয়।
সিরাজগঞ্জ এর তাঁত এর থ্রিপিসঃ
শুধু এই জায়গা গুলোই না, দেশে বিভিন্ন জেলার তাঁত এ থ্রিপিস তৈরি হয়। সিরাজগঞ্জ এ তাঁত আমাদের ইতিহাসে সমৃদ্ধ এবং এখানকার শাড়ি দেশ এর গন্ডি পেরিয়ে বিদেশে ও অনেক সমাদৃত। তাঁত এ থ্রিপিস উঠা খুব পুরনো কিছু না হলেও ক্রেতাচাহিদার কথা ভেবে বেশ কিছু ভ্যারিয়েশন এর থ্রিপিস করছেন সিরাজগঞ্জ এর তাঁতীরা।
আমরা নরমালি ব্লক এর সাথে জলছাপ ব্যাপার টা জেনে থাকলেও সিরাজগঞ্জ এর তাঁত এ এক ধরনের জলছাপ মিনাকারী থ্রিপিস হয়, যাতে পুরো কামিজ জুড়ে ই সুতায় পিটানো কাজ থাকে যা জলছাপ এর মত ই মনে হয়। এছাড়া ও স্বপ্নপুরী জামদানী থ্রিপিস, সুদান জামদানী, প্যানেল জামদানী নামে বেশ কিছু টাইপ এর থ্রিপিস হয় সিরাজগঞ্জ এ যার প্রচার হলে সামনে সিরাজগঞ্জ এর থ্রিপিস ও উঠে আসবে এবং উদ্যোক্তারা ভালো করবেন বলেই আশা রাখা যায়। উদ্যোক্তা রা এগিয়ে আসলেই সম্ভব দেশীয় এই পণ্যগুলোর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সাথে তাঁতীদের ও।
আদিবাসীদের তাঁত এর থ্রিপিসঃ
আদিবাসী রা নিজেদের পোশাক নিজেরাই বুনন করে থাকেন। আদিবাসী ভেদ এ তাদের পোশাকের নামের যেমন ভিন্নতা আছে তেমনি পোশাকের ধরণে ও আছে ভিন্নতা। এগুল্প থ্রিপিস না কিন্তু এখন যেহেতু প্রতিটি এলাকাতেই পর্যটকদের সংখ্যা বাড়ছে এবং পর্যটকরা নরমালি ই এসব এলাকায় গেলে কখনোই খালি হাতে ফেরেন না তাই দেখা যায় যে অনেকেই আদিবাসীদের তাঁত এ বোনা পোশাকগুলো নিজেরা নিয়ে এসে নিজেদের মত করে থ্রিপিস হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন। এমন কিছু পোশাক নিয়েই এখানে ছোট্ট করে আলোচনা করবোঃ
চাকমা দের পিনন-হাদিঃ
এক সময় চাকমা রা তাদের জুম ক্ষেতে উৎপাদিত তুলা থেকে তাদের নিজেদের পোশাক তৈরি করতেন কিন্তু সময়ের সাথে ব্যস্ততা বেড়েছে, পোশাকের ভ্যারিয়েশন তারা ও এখন নিজেদের বানানো তাঁত এর পোশাক এর সাথে ও বেছে নিয়েছে বাঙ্গালীয়ানা তাই তুলা উৎপাদন কমে গিয়েছে, পাশাপাশি চাহিদা তো আছেই। কেননা এখন শুধু চাকমা রা না, ঘুরতে যাওয়া বাঙালি রা ও এইসব পোশাক কিনে নিজেদের মত করে ব্যবহার করছেন। তার রেশ ধরে চাকমা রা নিজেদের তৈরি সুতার পাশাপাশি বাজার থেকে কেনা সুতা দিয়েও তাদের পোশাক তৈরি করছেন। পিনন এবং হাদি দিয়ে যথাক্রমে সালোয়ার এর কাপড় মিলিয়ে থ্রিপিস ব্যবহার করা যায় তাছাড়া চাকমা নারী রা ও পিনন কোমরের নীচের অংশে ব্যবহার করেন এবং হাদির সঙ্গে ব্লাউজ এর মত করে জামা পরিধান করে। মাথায় তারা খবং ও পরে৷ যে হিসাবে তিনটা টুকরো মানে থ্রিপিস এর মত ই হয়ে যায়৷
ফুরিত-ফানেক-ফিদপুঃ
মনিপুরী নারীদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক এটি। ফুরিত হলো ব্লাউজ এর মত যেটা উপরের অংশে পরে, ফানেক নীচের অংশে পরে সেলাইবিহীন এক টুকরো কাপড় এবং ফিদপু হলো এক টাইপ ওরনা যা ফুরিত এর উপর পরা হয়। তারা তাদের ট্র্যাডিশনাল প্রোগ্রাম গুলোতে এসব পরিধান করেন এবং উপরে ইনাফি নামের এক প্রকার চাদর টাইপ বস্ত্র পরেন। সেই হিসাবে এটি তিন টুকরো না চার টুকরো কাপড়ের মিশেলে তৈরি হয়৷ এ সব ই এখন মনিপুরী রা ছাড়া ও অনেকেই শখের বসে কিনে সেসব দিয়ে থ্রিপিস বানিয়ে পরেন।
এমন ঐতিহ্যবাহী পোশাক বাদেও মনিপুরী তাঁত এ এখন থ্রিপিস তৈরি হয় মনিপুরী শাড়ির মোটিফে। যাতে মনিপুরী টেম্পল পাড় টা বিদ্যমান থাকে। আসলে থ্রিপিস জনপ্রিয়তার শীর্ষে, তাই প্রচারণার মাধ্যমে নতুন নতুন থ্রিপিস তৈরিতে উদবুগ্ধ হচ্ছেন বিভিন্ন এলাকার বিভিন্ন সম্প্রদায় এর তাঁতীরা৷
রিনাই-রিসাঃ
বেশিরভাগ উপজাতিদের ঐতিহ্যবাহী পোশাকের ক্ষেত্রে সেলাইবিহিনী এক প্রকার পোশাক পরিলক্ষিত হয়। ত্রিপুরা নারীদের ক্ষেত্রে তা হলো রিনাই যা তারা কোমরের নীচে পরেন এবং এর সাথে থাকে রিসা। এখানে তারা নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী লতাপাতা, প্রজাপতি, ফুল, পাখি এসব নকশা তুলেন।
ম্রো উপজাতির মেয়েরা পরেন ওয়ানফ্লাই। এর সাথে ওয়ানচা নামক চাদর টাইপ পোশাক ও পরেন। এগুলোই তাদের ঐতিহ্যের অংশ৷
গারোদের দকমান্দাঃ
গারোদের দকমান্দা নিয় ইতিমিধ্যে ই-কমার্স এ উদ্যোক্তা উঠে এসেছেন, যারা এ নিয়ে কাজ করছেন এববগ কাস্টমার দের সুনজরেও পরেছেন৷ দকমান্দা ও এর ওরনার সাথে মিলিয়ে সালোয়ার নিয়ে থ্রিপিস হিসেবে পরছেন অনেক বাঙালীরা। বেশ সমাদৃত ও হয়েছে এই থ্রিপিস।
হালুয়াঘাট এর উপজাতি রা যেমন এটি তৈরি করে ত্রমনি মধুপুর এর গারোরা ও তাদের নিজস্ব তাঁত এ এমন অনেক পোশাক তৈরি করে৷ মধুপুর এ এইসব দকমান্দার ম্যাটেরিয়াল এ বিভিন্ন কূর্তি, সালোয়ার কামিজ ও তৈরি হয়, সেসবের সাথে ব্লক ও করা হয়৷ এসব শুধু নিজেদের ব্যবহার এর জন্য না, বাণিজ্যিক ভাবেও তৈরি হয় এবং অনেক ব্রান্ড, ই-কমার্স উদ্যোক্তাদের সাথে কনটাক্ট করে এসব বাহিরে বিক্রি ও করা হয়।
এমন অনেক উপজাতিদের পোশাকগুলোই এখন উপজাতি গোষ্ঠী বাদেও উঠে আসছে, ছড়িয়ে পরছে বিভিন্ন উপজাতিদের ট্র্যাডিশনগুলো অন্যত্র৷ তেমনি খাসি নারীদের পোশাক কা-জামপিন, জামাতা বা নিমাক্তি, এখানেও তারা চুসুত নামে এক ধরণের ওরনা জাতীয় পোশাক পরে৷ দারিদ্রতার সাথে লড়াই করে এই উপজাতি। জাফলং এর এদিকে এদের অনেক পরিবার আছে। তাদের তৈরি পোশাক গুলোকে তুলে ধরতে পারলে এবং এগুলো যে থ্রিপিস বা টুপিস হিসেবে আমরা ব্যবহার করতে পারি, এই বিষয়গুলো প্রচার করতে পারলে এদের অর্থ উপার্জন এর পথ সুগম হতে পারতো।
সাঁওতাল নারীদের পানচি ও পাড়হান কে ও সালোয়ার এর সাথে ব্যবহার করা যায়৷
নরসিংদীর থ্রিপিসঃ
দেশে উৎপাদিত বস্ত্রের জন্য সেরা নরসিংদী তে উৎপাদিত হয় বিভিন্ন ধরণের থ্রিপিস ও৷ এখানে টেক্সটাইল, ডায়িং সহ বিভিন্ন ধরনের পোশাক শিল্পকারখানা রয়েছে। সুতা থেকে কাপড় সবকিছুই এখানে প্রসেসিং হয়৷ নরসিংদী চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (এনসিসিআই) এর তথ্য অনুসারে, দেশের কাপড়ের চাহিদা প্রায় ৭০ ভাগ ই উৎপাদিত হয় এই জেলায়৷ বিক্রি ও হয় এখানের বাবুরহাট হাটে যা বাংলাদেশে কাপড় বিক্রির সবথেকে বড় পাইকারী হাট ৷ এখান থেকে দেশে বিভিন্ন জেলায় চলে যায় সুতা থেকে শুরু করে কাপড় সহ বিভিন্ন কিছুই। এখানে তাঁত সহ বিভিন্ন কারখানায় উৎপাদিত হয় বিভিন্ন ধরণের থ্রিপিস যা সারা দেশে সরবরাহ করা হয় এবং আমাদের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানো হয়। বিভিন্ন ম্যাটেরিয়াল এর সুতা থেকে সুতি, লন, ডিজিটাল প্রিন্ট, লিলেন সহ অন্যান্য অনেক থ্রিপিস এখানে পাওয়া যায় এবং এখানের কারখানা গুলোতে দেড় থেকে দুই লাখ শ্রমিক কাজ করেন। খুব সহজেই অনুধাবন করা যায় যে নরসিংদী তে কতটা সম্ভাবনা আছে আমাদের দেশীয় এ থ্রিপিসগুলো তুলে ধরার, শুধু নিজেদের কে সেভাবে ফোকাস করতে হবে, দেশীয় থ্রিপিস গুলো তাহলে নিজেদের জায়গা করে নিতে পারবে ক্রেতাদের নিকট।
কুষ্টিয়ার তাঁত এর থ্রিপিসঃ
তাঁত শিল্পে স্বনামধন্য ছিলো এক সময় কুষ্টিয়ার তাঁত। এক সময় এখানে এত পরিমাণ তাকতক বস্ত্র তৈরি হতো যে শুধু এ জেলাতেই বস্ত্রশিল্পের বার্ষিক আয় ছিল্প তিনশত কোটি টাকার উপর। ১৯৯০ সালের পর থেকে বিভিন্ন কারণে এ অবস্থা নিম্নবর্তী হতে থাকে এবং এখন কুষ্টিয়ার কুমারখালীর তাঁত এর অবস্থা বেশ খারাপ৷ কিন্তু তাঁতী আছে তাদের ঐতিহ্যবাহী পেশার সাথে জড়িত, এখনো বুনছেন কাপড়। থান কাপড়, গজ কাপড় তৈরি হয় এখানে। যা থেকে বানানো যায় থ্রিপিস। এছাড়া তাঁত এ থ্রিপিস ও বুনন হয়। কুষ্টিয়া তে রয়েছে পোড়াদহ কাপড়ের হাট, যা দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম কাপড়ের হাট। অর্থাৎ কাপড়ের বাণিজ্য এখানে চড়া, তবে এদিকে দৃষ্টি দিলে কুষ্টিয়ার তাঁত এর হারানো ঐতিহ্য ফিরে আসতে পারে এবং আমাদের দেশী থ্রিপিস এর বাজারে এখানকার তাঁত এর থ্রিপিস ও তাদের জায়গা করে নিতে পারবে।
লিনেন কাপড় এর থ্রিপিসঃ
লিনেন অত্যন্ত আরামদায়ক একটা ফেব্রিক। বিভিন্ন ফেব্রিক এ এলার্জি সমস্যা থাকিলেও লিনেন এ তা একেবারে নেই এবং লাইটওয়েট একটা ফেব্রিক জন্য লিনেন খুব্বি জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। লিনেন এর পোশাক শরীরের আদ্রতা বজায় রাখে, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে, ঘাম সহজেই বেরিয়ে যায় সব মিলিয়ে শরীরে স্বস্তি দেয় খুব৷ এই ম্যাটেরিয়াল কুচকে যায় না সহজে , হঠাৎ বেরিয়ে যেতে ইস্ত্রি করার প্রয়োজন হয়না, সেসব বৈশিষ্ট্যের কারণে এখন সুতির থেকেও এগিয়ে যাচ্ছে লিনেন। ব্যস্ত জীবনের সঙ্গী লিনেন এর শুধু কামিজ না সালোয়ার, স্কার্ট, টপস, ফতুয়া, লং স্কার্ট সব ই তৈরি হয়, এছাড়া গজ কাপড় তো আছেই যা দিয়ে যেকোন ডিজাইন এ তৈরি করা যায় যে কোন পোশাক।
সুতি কাপড় এর থ্রিপিসঃ
সুতি মানেই সসর্বজনীন একটি কাপড়, সবথেকে বেশি ব্যবহৃত বললেও ভুল হবেনা। সুতি মূলত তুলা বীজের চারপাশে এ তুলার আঁশ থাকে তাকে স্পিনিং এবং উইভিং প্রক্রিয়ায় তৈরি করা হয়। সুতির ফেব্রিক টা এতটাই আরামদায়ক যে গরমে বেস্ট অপশন হিসেবে সুতিকে ই বেছে নেয় সবাই। থ্রিপিস এর ক্ষেত্রেও ব্যাতিক্রম ঘটেনা৷ সুতিতে অনেক অনেক অপশন থাকার ফলে নিজের পছন্দময় বেছে নেয়া সুবিধা ও হয়।
সুতির অনেক অনেক ধরন হয়, সব ধরণের সুতি দিয়ে থ্রিপিস হয়না। যেমন Jersy knit, Twill, Cordoury, দিয়ে মূলত ট্রাওজার, শার্ট তৈরি হয় অথচ এগুলো সুতির ধরন এবং Canvas ও এক ধরনের সুতি ম্যাটেরিয়াল যা দিয়ে ব্যাগ, ক্যানভাস তৈরি তে ব্যবহার করা হয়। এমন অনেক সুতি ই আছে। তবে বেক্সি ফেব্রিক, ভয়েল, পপলিন সুতি, সাটিন, ফ্লানেল, লন এমন বিভিন্ন ধরণ আছে সুতির যা দিয়ে থ্রিপিস সহ বিভিন্ন ধরনের পোশাক প্রচুর আরামদায়ক হয় এবং চাহিদার শীর্ষে ও এগুলো আছে। সুতিতে এত ভ্যারিয়েশন আনা যায় এবং সব ভ্যারিয়েশন এ ই সুতি আরামদায়ক হয়৷ সুতির থ্রিপিস ঘরোয়া থেকে শুরু করে বাহিরে, অনুষ্ঠান পর্যন্ত চলে যায়, ধরণভেদে এবং ডিজাইনভেদে শুধু নিজেদের মত করে তৈরি করে নিতে হয়৷ এছাড়া ও কাপড়ে যত ধরনের ইনোভেশন করা যায় হাতের কাজ, ব্লক, বাটিক, এমব্রয়ডারি, কারচুপি সবকিছুতে সুতি খুব ই সুন্দর ভাবে মানিয়েও যায়।
জর্জেট কাপড় এর থ্রিপিসঃ
জর্জেট খুব জনপ্রিয় একটি ফেব্রিক। একদম সুতির মত মোলায়েম না হলেও জর্জেট এর ধরণ বুঝে এগুলো প্রচুর ব্যবহার করা হয়। জর্জেট এ কারচুপি বা এমব্রয়ডারি কাজ করে ধরণভেদে পার্টি, বিয়ে, জমকালো প্রোগ্রাম এর উপযোগী করে তোলা যায় খুব সহজে এবং এসবের জন্য খুব জনপ্রিয় ও৷
জর্জেট যেমন শক্ত হয় তেমনি খুব নিখুঁত বুননের জর্জেট ও হয়৷ সাধারণত ক্রপ ধরনের ফেব্রিক থেকে জর্জেট তৈরি হয়, তাছাড়া রেয়ন, ভিসকোস, পলিয়েস্টার জাতীয় সিনথেটিক ফাইবার থেকেও জর্জেট তৈরি হয়৷ জর্জেট এর কাপড়গুলোতে ভ্যারিয়েশন আনা যায় অনেক বেশি যা জমকালো হয় অনেক বেশি৷
সিল্ক এর থ্রিপিসঃ
সিল্ক অত্যন্ত নমনীয় একটি ফেব্রিক৷ সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপাদান থেকে প্রাপ্ত সিল্ক এ থ্রিপিস সেভাবে জনপ্রিয় না বা অনেক দামী পোশাক হিসেবে সিল্ক থ্রিপিস তেমন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি কারণ থ্রিপিস হলে তার দাম আরো অনেক বেশি হয়ে যায়, তাই থ্রিপিস সেভাবে না হলেও সিল্ক এর বিভিন্ন ধরনের থান থেকে ইদানীং থ্রিপিস করা হয়। সিল্ক এর গজ কাপড় পাওয়া যায়, সিল্ক এর ওরনা হয় যা বিভিন্ন ডিজাইন এ একসাথে মিলিয়ে পরা হয়৷ এছাড়া সিল্ক এ এমব্রয়ডারি করে অত্যন্ত সুন্দর থ্রিপিস হয়৷ সিল্ক এ হ্যান্ডপেইন্টিং ও খুব জনপ্রিয়তা পাচ্ছে৷
ব্লক থ্রিপিসঃ
সকলের জানা থ্রিপিস এর একটি ধরণ হলো ব্লক৷ কাঠের উপর খোদাই করা নকশা হলো ব্লক এবং এই ব্লক দিয়ে ছাপা হয় যে কাপড় এগুলোই হলো ব্লকপ্রিন্ট এর কাপড় এবং এসব দিয়েই বানানো হয় বিভিন্ন ধরনের পোশাক, থ্রিপিস। সাধারণত এক কালার এর উপর নানান মোটিফে ব্লক করে তা সুন্দর রূপ দেয়া হয়৷ কাঠব্লক এর মাধ্যমে সুতি, সিল্ক, খাদি, হাফসিল্ক সব ধরনের কাপড়ে ই ব্লক করা যায়। কোয়ালিটির উপর সাধারণত দাম ভ্যারি করে। কোয়ালিটিফুল ব্লক এর থ্রিপিস গুলো অনায়াসে অনেক দিন ব্যবহার করা যায় এবং আরাম জন্য সচারাচর ব্যবহার এ খুব জনপ্রিয় ব্লকপ্রিন্ট এর থ্রিপিস।
হাতের কাজের থ্রিপিসঃ
আমাদের আবহমান গ্রামীণ বাংলার নারীদের হাতে সুই আর সুতোর খেলায় ফুটে উঠে তাদের মনের আবেগ, গ্রাম বাংলা, লতা পাতা ফুল পাখি সব। অত্যন্ত সুন্দর নকশা ফুটিয়ে তুলেন নারীরা। জামালপুর, যশোর এর এসব হাতের কাজ অনেক বেশি পরিচিতি পেলেও শুধু এই দুই জেলা না বরং আমাদের দেশে প্রতিটা জেলায় অনেক অনেক নারী কর্মীরা এসব কাজ করেন এবং বিভিন্ন কাজের পাশাপাশি তাদের এই কাজ তাদের আয়ের আরেকটা সুযোগ ও হয়।
এখন জেলায় উপায় জেলায় হস্তশিল্পের উপর বিভিন্ন ট্রেইনিং দেয়া হয়, আছে অনেক সরকারি বেসরকারি প্রজেক্ট ও, যা এই শিল্পকে অনেক এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে৷ দেশ এর ভেতর না আমাদের দেশের হস্তশিল্প জায়গা করে নিয়েছে বাহিরের অনেক দেশে ও।।
সুতি, বেক্সি ভয়েল, ভয়েল, অরবিন্দ ভয়েল, জর্জেট, মসলিন, সিল্ক সব ধরনের কাপড়েই হাতের কাজ তোলা যায় এবং এসবের ব্যাপক চাহিদা আমাদের দেশের হস্তশিল্প কে আলাদা পরিচিতি দিচ্ছে৷ আগে যেমন লাখনৌ বা এই টাইপ ড্রেস গুলো শুধুমাত্র বিদেশী ভাবা হতো অথচ এসব আমাদের নারীরা অত্যন্ত সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারে। ফুলকারী জামা, গুজরাটি, ভরাট বা নিজের পছন্দমত কাজ, কালার, নিজের কমফোর্ট এর ম্যাটেরিয়াল এর উপর পছন্দসই ডিজাইন ও করিয়ে নেয়া যায় যা থ্রিপিস প্রেমীদের বাড়তি সুবিধা দেয়।
বাটিক এর থ্রিপিসঃ
বাটিক নামটা মানেই আরাম আরাম একটা ভাব চলে আসে এবং আসলেও তাই। আরামপ্রেমীদের পোশাকের অপশনে বাটিক হতে পারে অন্যতম বেস্ট অপশন। বাটিক দিয়ে এখন নানান ধরনের পণ্য তৈরি হয়, থ্রিপিস তো আছেই। বাটিক কে শুধু সুতি ভাবলে তা ভুল, বাটিক বিভিন্ন কাপড়ে হয় এবং দামের পার্থক্য এখান থেকেই হয়৷
অনেকেই বাটিক এবং ভেজিটেবল ডাই কে গুলিয়ে ফেলেন৷ আপাতদৃষ্টিতে এক রকম মনে হলেও দুটো সম্পূর্ণ ই আলাদা৷ বাটিক এর বিভিন্ন ধরণ আছে, যেমনঃ
- টাইডাই বাটিক
- মোম বাটিক
- তুলি বাটিক
- বরফি বাটিক
- চুনড়ি বাটিক
- শিবুরি বাটিক
- মাকড়সা বাটিক
- কুমিল্লার বাটিক
কেমিক্যাল রঙ দিয়ে করা হয় এগুলো৷ কিন্তু যা ভেজিটেবল ডাই বা ন্যাচারাল ডাই এসব শতভাগ প্রাকৃতিক রঙ৷ বিভিন্ন ফল, সবজি পেয়াঁজ এর খোসা, হকুদ, কফি, হরতকি, ডালিমের দানা, মেহেদী, তুলসী, কাঁচা হলুদ, গাঁদা ফুলের পাঁপড়ি, অর্জুন এর ছাল, গাব, খয়ের, সুপারি, এলাচ এমন বিভিন্ন প্রাকৃতিক উৎস গুলো থেকে প্রাপ্ত রং দিয়ে করা হয় ভেজিটেবল ডাই৷
নরমাল সুতি থেকে সুতি করে বেক্সি ভয়েল বা অনেক ভালো সুতি এমনকি মসলিন এর থান এ ও এখন বাটিক করা হয়, ভেজিটেবল ডাই করা হয়৷ নিত্য নতুন ইনোভেশন বাটিক শিল্পকে আলাদা একটা জায়গা দিয়েছে।
খেস থ্রিপিসঃ
পুরাতন সুতি কাপড় কে ছিঁড়ে ছোট ছোট সরু দড়ির মত ফালি করে একসাথে বুনন করে নতুন এক ধরনের ফেব্রিক তৈরি হয় যা খেস নামে পরিচিত। খেস এর সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম। শান্তিনিকেতন এর বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিল্পীদের হাতের ছোঁয়ায় খেসের হাতেখড়ি হয় যাতে সেই সময়ে তাঁতীরা বাংলার কাঁথা সেলাই এর আঙ্গিকে ফুটিয়ে তুলতেন।
বাংলাদেশের টাঙ্গাইল এ ও তৈরি হয় খেস এর শাড়ি। সেই শাড়ি থেকেই এখন তৈরি হচ্ছে কামিজ, ওরনা, যা সালোয়ার এর সাথে ম্যাচিং করে থ্রিপিস হিসেবেই পরছেন মেয়েরা। অত্যন্ত আরামদায়ক এবং পরিবেশবান্ধক এ খেস এর রয়েছে অনেক সম্ভাবনা শুধু প্রচারণা বাড়াতে হবে৷
কুমিল্লার খাদি থ্রিপিসঃ
অত্যন্ত পুরনো একটি ঐতিহ্য আমাদের কুমিল্লার খাদি। খাদ থেকে অর্থাৎ গর্ত তাঁত থেকে তৈরি হয় এ বস্ত্র। ১৯২১ সালে গান্ধীজি যখন অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন এবং বিদেশী বস্ত্র বর্জন এর কথা বলেন তখন খাদি শিল্প ব্যাপক বিস্তার লাভ করে৷ সেই সময় রাঙ্গামাটি থেকে তুলা এনে তৈরি হতো খাদি বস্ত্র৷ এই কাপড় নিজের ঐতিহ্য নিয়ে সগর্বে চলতে থাকলে যুদ্ধ পরবর্তী সময় থেকে হাড়িয়ে যেতে থাকে এর ঐতিহ্য। ই-কমার্স এর হাত ধরে এখন আবারো ফিরছে কুমিল্লার এই ঐতিহ্য খাদি। শাড়ি কাপড়, পাঞ্জাবীর পাশাপাশি খাদি দিয়ে তৈরি হয় থ্রিপিস। খাদি র থান থেকে যুগোপযোগী কূর্তি, আধুনিক ডিজাইন এর থ্রিপিস, তাতে আবার হ্যান্ডপেইন্ট, হাতের কাজ, এমব্রয়ডারি বিভিন্ন এক্সট্রা কাজ করানো হয় এবং খুব সুন্দর ও লাগে। খাদি দেশে যেমন বিখ্যাত রপ্তানি ও হয় বিভিন্ন দেশে। ফ্রান্স, স্পেন, তুরস্ক, ডেনমার্ক সহ অনেক দেশে খাদির পোশাক রপ্তানি হয়।
পাটের থ্রিপিসঃ
পাট আমাদের সোনালী আঁশ। পাট উৎপাদনে আমাদের দেশ বিশ্বে প্রথম, রপ্তানি তে দ্বিতীয়। পাট এর কত কত পণ্য যে বাহিরে রপ্তানি হয় তা নিয়ে না হয় এই আর্টিকেল এ ডীপ এ না যাই। কিন্তু পাট এর থ্রিপিস এর ব্যাপক চাহিদা আছে তা অবশ্যই বলতে পারি। পাটের ফাইবার থেকে প্রাপ্ত সুতা দিয়ে তৈরি হয় অন্যান্য অনেক বস্ত্রের মত থ্রিপিস ও। অত্যন্ত মানানসই, অনেক কোয়ালিটিসম্পন্ন পাটের থ্রিপিস আমাদের ঐতিহ্য বহন করে। পাট এর ফাইবার এর সাথে আনারস ও কলা গাছের ফাইবার থেকে পাওয়া সুতা দিয়ে তৈরি হয় শতভাগ প্রাকৃতিক তন্তুর এ থ্রিপিস।
পাট পণ্যের উপর আমাদের আবেগ মিশে আছেই, পাট পণ্যের বিশ্ববাজারে এবং দেশে চাহিদা ও প্রচুর। তাই পাটের থ্রিপিস আমাদের দেশীয় থ্রিপিস এ একটি গর্বের জায়গা নিতে পারে। পাট ফাইবার এ যেমন হাফসিল্ক হয় তেমনি পাট ফাইবার এর কটন ও হয়, ইভেন জুট কটন এর যে থান হয় তাতে বিভিন্ন হাতের কাজ বা অন্যান্য অনেক ইনোভেশন এনে সেগুলো দিয়ে থ্রিপিস তৈরি হয় এবং খুব সুন্দর ও আরামদায়ক এই জুটকটন কাপড়।
থ্রিপিস এর গন্ডি টা এত বিশাল যে এ নিয়ে কাজ করার সুযোগ অনেক বেশি। উপরিউক্ত থ্রিপিস ছাড়াও অনেক কাপড়ের, নানান মোটিফ এ বিভিন্ন ধরনের থ্রিপিস হয় আমাদের দেশে। যে দেশে পাখি ড্রেস এর জন্য আত্মহত্যা হয় সেই দেশ থ্রিপিস এ যে কতটা স্বয়ংসম্পূর্ণ তা যদি তুলে ধরা যায় তবে আসলেই আমাদের বস্ত্রশিল্পের এ খাত সারাবিশ্বে সুনাম কুড়াতে সক্ষম। এখানেই ডিজাইনার লেহেঙ্গা হয়, বিভিন্ন দামী পাথর বা স্টোন চুমকি পুঁথি দিয়ে কাজ করিয়ে চোখধাঁধানো থ্রিপিস, আনারকলি, সারারা ড্রেস থেকে শুরু করে মনের মত সব ই করা সম্ভব হয় কারণ রিসোর্স আমাদের হাতের নাগালেই আছে। তাই থ্রিপিস সেক্টর নিয়ে কাজের ক্ষেত্র টা আমাদের অনেক বেশি। তবে সময় দিতে হবে, বের করে আনতে হবে এইসব সম্ভাবনাময় নানান ধরনের থ্রিপিস এবং এসব নিয়ে লিখতে হবে, নিজে জানতে হবে ও জানাতে হবে, তবেই থ্রিপিস এর নানান ধরণ নিয়ে মানুষ জানবে, আগ্রহ তৈরি হবে দেশী থ্রিপিস এর প্রতি। এর ফলে একদিকে যেমন এই সেকটর এর বাজার বড় হবে অন্যদিকে অনেক নতুন কর্ম সংস্থান তৈরি হবে, রিসোর্স এতটাই পূর্ণ যে দেশ ছাড়িয়ে বিদেশ রপ্তানি তে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে আমাদের দেশীয় থ্রিপিস। সকলের সম্মিলিত চেষ্টায় এসব ই সম্ভব হবে। ই-কমার্স সেদিক থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অলরেডি পালন করে চলছে।
লেখিকাঃ