খাদি শাড়ি

চরকায় কাঁটা সুতা থেকে হস্তচালিত তাঁতে বোনা দেশীয় খাদি শাড়ি আমাদের সুপ্রাচীন তাঁত ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের স্মৃতি বিজড়িত খাদির কথা উঠলে আমরা অনেকেই হয়তো শুধুমাত্র অফহোয়াইট চাদর, পাঞ্জাবী বা ধূতিকে বুঝে থাকি, কিন্তু বর্তমানে শাড়ীর পাশাপাশি খাদি কাপড়ের তৈরি থ্রি-পিস, শীতের পোশাক, গহনাসহ অন্যান্য পণ্যও বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে যা একাধারে অত্যন্ত আরামদায়ক, রুচিশীল ও মানসম্মত।

আমাদের ইতিহাস-সমৃদ্ধ তাঁত শিল্পের ধারাবাহিকতায় খাদির আবির্ভাব। খাদি শাড়ির মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর কোমল, সিগ্ধ ও টেকসই রং এবং হাতের চমৎকার বুনন শৈলী। পূর্বে খাদি শাড়ি সম্পর্কে একটি ভুল ধারনা ছিল যে এটি ২০ থেকে ৪০ কাউন্টের মোটা সুতায় উৎপাদিত সাদা বা সাদাটে একরঙা মোটা শাড়ি যা শুধুমাত্র শীতকালে ব্যবহার উপযোগী। কিন্তু কালের পরিক্রমায় সাদা বা সাদাটে রঙের খোলস থেকে বেরিয়ে এসে বিচিত্র সব রঙের ছোঁয়ায় খাদি শাড়ি নিজেকে রাঙ্গিয়েছে নিত্য নতুন রুপে। পাশাপাশি হাতে বোনা খাদি শাড়ি কিছুটা মোটা ও অমসৃণ হলেও এটি তাপ সুপরিবাহী হওয়ায় শীত-গ্রীষ্ম উভয় ঋতুতেই সমানভাবে ব্যবহার উপযোগী। উপরন্তু কার্পাস তুলার পাশাপাশি রেশম, অ্যান্ডি, মুগা, তসর, উল প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের তন্তুর সংমিশ্রনে তৈরি আজকের খাদি শাড়ি আগের চেয়ে অনেক বেশি পাতলা ও ফ্যাশনেবল হয়ে উঠেছে এবং শাড়ির ডিজাইনেও শোভা পাচ্ছে  নিত্য নতুন প্যাটার্ন। বৈচিত্র্যময় রঙ ও বাহারি ডিজাইনের নান্দনিক ফিউশনে উত্তরোত্তর আরও আধুনিক হয়ে উঠছে খাদি শাড়ি।

বর্তমানে বিভিন্ন ধরণের সুতা বা তন্তুর সঠিক সংমিশ্রণে (যেমনঃ সুতি ও রেশম সুতা) তৈরি হচ্ছে খাদি শাড়ি। খাদির এই ব্লেন্ডিং এর কল্যাণেই খাদি সিল্ক শাড়ির মতো নতুন অনেক শাড়ি দেশব্যাপী জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। দেশের অভ্যন্তরীণ বাজার ছাপিয়ে বিশ্ব বাজারেও খাদির চাহিদা আজ ঊর্ধ্বমুখী। যুক্তরাজ্য, কানাডা, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়াসহ ফ্রান্স ও ইতালির মতো ইউরোপের বিভিন্ন দেশেও আজ খাদি রপ্তানি হচ্ছে। এখানে উল্লেখ্য যে, ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া, চীন, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার মতো এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশেও খাদি ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে।

কুমিল্লার খাদিঃ

বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী খাদি শিল্পের অন্যতম আদি নিবাস কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম জেলায়। ভারতে ১৯২১ সালে ব্রিটিশ বিরোধী অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে মহাত্মা গান্ধী কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলায় এসেছিলেন স্থানীয় তাঁতিদের উৎসাহ দিতে। বিদেশী কাপড় বর্জন করে দেশীয় কাপড়ের ব্যবহার বাড়িয়ে ‘স্বরাজ’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে খাদি কাপড়কে অন্যতম উপকরণ হিসেবে বেছে নেন গান্ধীজী। মূলত সেই সময় থেকেই খাদি কাপড় উৎপাদনের প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠে কুমিল্লা। সেসময় দেশের চাহিদা পূরণ করে বিদেশেও রপ্তানী হতো খাদি কাপড়। আর এভাবেই খাদি শিল্পের সাথে জড়িয়ে গিয়েছে বৃহৎ ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস।

তৎকালীন সময়ে গান্ধীজির প্রতিষ্ঠিত কুমিল্লার অভয় আশ্রম খাদি শিল্পের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলো। সে সময় মূলত রাঙ্গামাটির কার্পাস তুলা থেকে হস্তচালিত চরকায় সুতা কেটে দেশীয় তাঁতে তৈরি হতো খাদি কাপড়। পরবর্তীতে কুমিল্লার খাদি শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (বার্ড) – এর প্রতিষ্ঠাতা ড. আখতার হামিদ খান এবং তৎকালীন গভর্নর ফিরোজ খান নুনের সহযোগিতায় ১৯৫৬ সালে অভয়াশ্রমকে কেন্দ্র করে ‘দি খাদি অ্যান্ড কটেজ ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন’ প্রতিষ্ঠিত হয়। উক্ত প্রতিষ্ঠানের হাল ধরেন চান্দিনার শৈলেন্দ্রনাথ গুহ ও তার পরিবার যারা পরবর্তীতে দেশীয় খাদি শিল্পের বিকাশে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। কুমিল্লার পাশাপাশি চট্টগ্রামের প্রবর্তক সংঘ ও নোয়াখালীর গান্ধী আশ্রমেও সে সময় খাদি কাপড় বোনা হতো।

খাদ বা গর্ত তাঁত

বর্তমানে দেশের অন্যান্য তাঁত পল্লিগুলোতেও (যেমন টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ) স্বল্প পরিসরে খাদি শাড়ি উৎপাদিত হচ্ছে যা মূলত নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন বস্ত্র মিল থেকে প্রাপ্ত সুতা ও হাতে কাটা সুতার সমন্বয়ে তৈরি হয়। তবে এটা অনস্বীকার্য যে খাদি শিল্পের সাথে কুমিল্লার নাম আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। কুমিল্লার সদর ও চান্দিনা উপজেলা মূলত আসল বা খাঁটি খাদি শাড়ি উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত। বর্তমানে কুমিল্লার প্রায় দেড় হাজার তাঁতি পরিবার খাদি শাড়িসহ অন্যান্য খাদি পণ্য উৎপাদনের সাথে জড়িত। নগরীর রাজবাড়ী এলাকায় খাদি পণ্যের আলাদা বিক্রয় কেন্দ্রসহ প্রায় শতাধিক দোকান রয়েছে। স্থানীয় বাজারে ডিজাইন ও মান ভেদে খাদি শাড়ির বিক্রয়মূল্য ৪০০ থেকে ২৮০০ পর্যন্ত হয়ে থাকে।

এছাড়াও কুমিল্লার ময়নামতি, মুরাদনগর, গৌরীপুর, মাধাইয়া, কলাগাঁও, কুটুম্বপুর, হারং, বানিয়াচং, ভোমরকান্দি, বেলাশ্বর, মধ্যমতলা, বাড়েরা, গোবিন্দপুর, ছয়ঘড়িয়া, হাড়িখোলা ও দেবিদ্বার উপজেলার বরকামতা, নবীয়াবাদ, জাফরাবাদ, সাইতলা, বাখরাবাদ, ভানী গ্রামসমূহ খাদি কাপড় উৎপাদনের জন্য প্রসিদ্ধ যেখানে তাঁতিরা বংশপরস্পরায় খাদি শাড়ি উৎপাদন করে আসছে। পাশাপাশি দেশের বেশ কিছু স্বনামধন্য ফ্যাশন ব্র্যান্ড ও ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান খাদির উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে এবং তাদের মাধ্যমে  ফ্রান্স, স্পেন, ডেনমার্ক, তুরস্কসহ ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে খাদি পণ্য রপ্তানি হচ্ছে।

খাদি শাড়ির নামকরন ও ইতিহাসঃ

উপমহাদেশে খাদি কাপড়ের বুনন প্রক্রিয়ার প্রচলন আদিকাল থেকেই। মূলত মুঘল আমলে সম্রাট ও নবাবদের পৃষ্ঠপোষকতায় শুরু হয় খাদির স্বর্ণযুগ। মাকড়সার জালের মতো অতি উচ্চ কাউন্টের সূক্ষ্ম খাদি কাপড় তৈরি হতো পেশাদার তাঁতিদের তাঁতে এবং উন্নতমানের কাপড় হিসেবে সমাজে এগুলোকে বিশেষ কদর করা হতো। ১৭শ শতাব্দীতে ত্রিপুরা রাজ্যেও খাদি কাপড়ের বুনন বেশ প্রচলিত ছিল। তবে ব্রিটিশ শিল্প বিপ্লবের পর থেকে খাদি শিল্পের পটপরিবর্তন হতে শুরু করে। পরবর্তীতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকের হাতে স্থানীয় তাঁতিদের অসহনীয় অন্যায়, অত্যাচার, শোষণ এবং মেশিনে তৈরি স্বল্পমূল্যের কাপড়ের সাথে প্রতিযোগিতায় অনেকটাই পিছিয়ে পরে খাদি শিল্প। অন্যদিকে দেশে-বিদেশে অতি সূক্ষ্ম মসলিন কাপড়ের চাহিদা বাড়তে শুরু করায় তাঁতিরা মসলিন উৎপাদনে অধিক আগ্রহী হয়ে উঠে। 

তবে বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ব্রিটিশ বিরোধী ‘স্বদেশী’ আন্দোলনে মহাত্মা গান্ধীর ডাকে সাড়া দিয়ে সাধারণ মানুষ ব্যাপকহারে বিদেশী কাপড় বর্জন করে দেশী কাপড় পরতে শুরু করলে দেশব্যাপী খাদি কাপড়ের চাহিদা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। বর্ধিত এই চাহিদার যোগান দিতে তৎকালীন হিন্দু যোগী ও নাথ (বা দেবনাথ) সম্প্রদায়ভুক্ত পেশাদার তাঁতি গোষ্ঠী দ্রুত তাঁত সঞ্চালনার জন্য পায়ে চালিত প্যাডেলের নিচে মাটিতে গর্ত করে খাদ বা গর্ত তাঁত থেকে কাপড় বুনতে শুরু করে। আর এই  গর্তের বা খাদের চরকায় তৈরি হতো বলেই ‘খাদি’ বা ‘খদ্দর’ নামের প্রচলন শুরু হয়।  তবে কেউ কেউ গুজরাটি ‘খদ্দর’ শব্দ থেকে ‘খাদি’ শব্দের উৎপত্তি বলে ধারণা করে থাকেন। যেহেতু খাদি শিল্পকে জনপ্রিয় করার পেছনে গুজরাটের বাসিন্দা মহাত্মা গান্ধীর গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রয়েছে তাই ‘খাদি’ শব্দটি গুজরাটি ভাষা থেকে আগত বলে অনেকেই মতপ্রকাশ করেন।

পরিশেষে বলতে হয়, বাংলার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় এবং শতবছরের গ্রামভিত্তিক বাজার ব্যবস্থার বিবর্তনে খাদি শাড়ি আজ বাঙালি সমাজে নিজের একটি শক্ত অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে।

লেখিকাঃ

Amrita Rani Deb

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top