সন্দেহ নেই, বাঙালী নারীর আভিজাত্যের প্রতীক ঢাকাই জামদানী শাড়ি। যুগ যুগ ধরে দেশীয় ঐতিহ্য ও উৎকৃষ্ট বুননশৈলীর সেরা উদাহরণ এই শাড়ি। আমাদের হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী সূক্ষ্ম মসলিন শাড়ির একমাত্র উত্তরসূরী হিসেবে এখনও ঢাকাই জামদানী উৎপাদিত হচ্ছে এবং বাঙালি নারীর হৃদয়ে নিজের জনপ্রিয়তা সগর্বে ধরে রেখেছে।
বিয়ে হোক কিংবা হোক অন্য কোন আনন্দোৎসব- বাঙালী নারীর পছন্দের শীর্ষে অবস্থান জামদানী শাড়ির। মূলত নিখুঁত, বৈচিত্র্যময় বুননশৈলী ও নকশার জন্যই জামদানি শাড়ি পুরো বিশ্বে এক নামে সমাদৃত। একসময় কার্পাস সুতোয় বোনা নকশী মসলিন শাড়িকে জামদানী বলা হতো। ২০১৬ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক জিআই (Geographical Indication) পণ্যের স্বীকৃতি প্রাপ্ত ঢাকাই জামদানীকে ফিগারড্ মসলিনও বলা হয়।
প্রাচীন মসলিনের উত্তরসূরী হিসেবে জামদানীর ইতিহাসও বেশ পুরনো। খ্রিষ্টের জন্মের আগে থেকেই মসলিন ও জামদানি কাপড়ের প্রচলন শুরু হয়েছিলো। তবে ইতিহাসের পাতায় প্রথম কোন লিখিত বিবরণীতে জামদানি সম্পর্কে জানা যায় আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে কৌটিল্য বা চাণক্য রচিত ‘অর্থশাস্ত্র’ নামক গ্রন্থে, যেখানে প্রাচীন বঙ্গ ও পুণ্ড্র নামক রাজ্যে বা জনপদে এক প্রকার মিহি বস্ত্র তৈরির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। পরবর্তীতে আনুমানিক ৮০ খ্রিষ্টাব্দে জনৈক গ্রীক নাবিকের লেখা ‘পেরিপ্লাস অব দ্য এরিথ্রিয়ান সি’ নামক বইতেও বঙ্গ অঞ্চলে তৈরি মিহি কাপড়ের উল্লেখ রয়েছে। এছাড়াও পরবর্তী সময়ে চীন, আরব ও ইতালি থেকে আগত পর্যটক ও বণিকদের দেয়া বিবরণী থেকেও নিশ্চিতভাবেই উঠে আসে প্রাচীন বঙ্গের মিহি বা সূক্ষ্ম বস্ত্রের প্রসঙ্গ।
তাই এটা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, বাংলার মসলিন ও জামদানি সুপ্রাচীন কাল থেকেই এমনকি আন্তর্জাতিক মহলেও আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলো। খ্রিষ্টীয় নবম শতাব্দীর আরব ভূগোলবিদ সোলায়মান থেকে শুরু করে চতুর্দশ শতাব্দীর বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা, যোড়শ শতাব্দীর ইংরেজ ভ্রমণকারী র্যালফ ফিচ এবং মুঘল আমলের ঐতিহাসিক আবুল ফজল- তারা সবাই নিজেদের লেখনীতে বাংলার মিহিবস্ত্র তথা মসলিন ও জামদানির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। বিশেষ করে পর্যটক ইবনে বতুতা তার বাংলা পরিভ্রমণ করে লেখা বিবরণিতে সোনারগাঁয়ের উৎকৃষ্টমানের সুতিবস্ত্রের ব্যাপক প্রশংসা করেছেন।
মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের সামসময়িক ঐতিহাসিক টেলর জামদানি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়ে গেছেন। তাঁর দেয়া বিবরণী থেকে জানা যায়, সে সময় ১০ হাত × ২ হাত সাইজের এবং ৫ শিক্কা ওজনের একটি আব-ই-রওয়ান (ফার্সি এই শব্দগুচ্ছের অর্থ হলো ‘প্রবাহিত পানি’- যা মূলত মসলিনের সূক্ষ্মতা বোঝাতে উপমা হিসেবে ব্যবহৃত হতো) এর বাজার মূল্য ছিলো ৪০০ টাকা। সম্রাট আওরঙ্গজেবের জন্য প্রস্তুত একটি জামদানি বস্ত্রের মূল্য ছিলো ২৫০ টাকা। তবে একেবারে সেরা মানের একটি ঢাকাই জামদানির মূল্য ১৭৭৬ সালে ছিলো ৪৫০ টাকা। এখানে উল্লেখ্য, জামদানি বলতে এখন আমরা যদিও মূলত শাড়িকে বুঝে থাকি, কিন্তু পূর্বে বিশেষ করে মুঘল আমলে জামদানী কাপড় থেকে কুর্তা, পাগড়ি, রুমাল, ওড়না, পর্দা ইত্যাদিও তৈরি হতো। রাজসিক অনুষ্ঠানে ও সমাজের অভিজাত শ্রেণীর মাঝে মসলিন ও জামদানী দারুনভাবে সমাদৃত ছিলো।
জামদানী নামকরন নিয়ে বিভিন্ন মতবাদ প্রচলিত থাকলেও ধারনা করা হয় জামদানি শব্দটি এসেছে ফার্সি শব্দ ‘জামা’ ও ‘দানা’ থেকে। এক্ষেত্রে ‘জামা’ শব্দের অর্থ হচ্ছে কাপড় এবং ‘দানা’ শব্দটির অর্থ হলো বুটি। অর্থাৎ, ব্যুৎপত্তিগত অর্থের দিক থেকে ‘জামদানী’ বলতে মূলত বুটিদার কাপড় বা শাড়িকে বোঝানো হয়। তবে ভিন্নমত পোষণকারী কেউ কেউ মনে করেন যে, ফার্সি ভাষায় ‘জাম’ অর্থ হচ্ছে এক প্রকার উন্নত মানের মদ, আর ‘দানি’ শব্দের অর্থ হলো পেয়ালা; ফলে জাম বা মদ পরিবেশনকারী ইরানী সাকির পরিধেয় মসলিন কাপড় থেকেই ‘জামদানী’ নামটি এসেছে।
তবে নামের বুৎপত্তিগত ইতিহাস যেমনই হোক, জামদানীর আদি নিবাস যে ঢাকাতেই তাতে কোন সন্দেহ নেই। শীতলক্ষ্যা নদীর আর্দ্র আবহাওয়া জামদানি শাড়ির জন্য বিশেষ উপযোগী, ফলে শীতলক্ষ্যা তীরবর্তী নারায়ণগঞ্জ, সোনারগাঁ, রূপগঞ্জ, নোয়াপাড়া ও এর আশপাশের এলাকায় সেই সুপ্রাচীন কাল থেকেই জামদানী শাড়ি বুনন করা হচ্ছে। বর্তমানে রুপগঞ্জের নোয়াপাড়াতে জামদানি পল্লী রয়েছে। এখানকার স্থানীয় তাঁত শিল্পীরা বংশপরস্পরায় এই শিল্পের সাথে যুক্ত। তাদের দক্ষ হাতেই এখানে বোনা হয় ২৬-৮০-৮৪ থেকে শুরু করে ৫০০ কাউন্টের সূক্ষ্ম ও হালকা জামদানী শাড়ি। মূলত জামদানি শাড়ির মান নির্ভর করে সুতার কাউন্টের উপর- যে শাড়ীতে সুতার কাউন্ট যত বেশি সেই কাপড় তত বেশি মিহি ও হালকা হয়ে থাকে। এখানে উল্লেখ্য, প্রাচীন বঙ্গে ও পুণ্ড্রে প্রচলিত ক্ষৌম, দুকুল, পত্রোর্ণ ও কার্পাসী- এই ৪ প্রকার কাপড়ের মধ্যে ‘দুকুল’ নামক কাপড়ের বিবর্তিত রুপই হলো মসলিন, এমনটাই মত ঐতিহাসিকদের।
বর্তমানে ঢাকার পাশাপাশি দেশের অন্যান্য প্রান্তের তাঁত শিল্পীদের হাতেও জামদানি তৈরি হচ্ছে। পাশাপাশি মেশিনেও বোনা হচ্ছে জামদানী শাড়ি। তবে মেশিনে তৈরি জামদানি কোনভাবেই মানের দিক থেকে হাতে বোনা ঢাকাই জামদানীর সমকক্ষ নয়। সুতার সূক্ষ্মতা ও নকশা দুদিক থেকেই বিস্তর ব্যবধান চোখে পরে হাতে বোনা ও মেশিনে বোনা জামদানি শাড়ির মধ্যে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মেশিনে তৈরি জামদানী বোনা হয় তুলা ও রেশম সুতার মিশ্রণে যাকে হাফসিল্ক জামদানী শাড়ি বলে। অন্যদিকে সম্পূর্ণ তুলায় বোনা জামদানীকে ফুল কটন জামদানী ও সম্পুর্ন রেশম সুতোয় বোনা জামদানীকে ফুলসিল্ক জামদানী বলা হয়ে থাকে।
জামদানী শাড়ির মূল আকর্ষণ হচ্ছে কার্পাস তুলা থেকে প্রাপ্ত সূক্ষ্ম বা মিহি সুতার ওপর করা বাহারি নকশা ও চমৎকার কারুশৈলী। এই শাড়ি তৈরিতে মূল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে হাতের বুননে সুতোয় সূক্ষ্মতা বজায় রেখে শাড়িতে বাহারী জ্যামিতিক নকশা ফুটিয়ে তোলা যা একইসাথে অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ ও শ্রমনির্ভর কাজ। রেশম গুটি থেকে সুতা প্রস্তুত করা থেকে শুরু করে মোট ৯ থেকে ১০ ধাপের বুনন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পরিচালিত হয় জামদানী শাড়ি তৈরির কাজ। মূলত সুতার কাউন্ট বা সুক্ষতা এবং শাড়িতে ফুটিয়ে তোলা নকশার জটিলতার উপর নির্ভর করে একটি জামদানী শাড়ি তৈরির সময় ও শ্রম। সূক্ষ্মতা ও নকশাভেদে একটি জামদানী শাড়ি তৈরিতে তাঁতিদের দুই থেকে ছয়মাস সময় পর্যন্ত সময় লেগে যায়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই জামদানি শাড়ির দামও বেশি হয়ে থাকে।
অন্যদিকে জামদানী শাড়ির সূক্ষ্মতা ও নকশা কিন্তু নির্ভর করে ভিন্ন ভিন্ন সুতার ব্যবহার ও নকশার বৈচিত্র্যময়তার উপর। তাঁতিদের হাতের নিপুন দক্ষতায় শাড়ির জমিন ও আচলজুড়ে বাহারী মোটিফের কাজ যত নিখুঁত ও মসৃণ হবে জামদানী শাড়ির দামও তত বেশি হবে।
জামদানী শাড়ির মধ্যে সবচেয়ে মুল্যবান হচ্ছে ‘পান্না হাজারী’ যার নকশা করা হয় সোনালী রুপালী সুতোয়। এছাড়াও কলকি, ফুল, লতা কিংবা জ্যামিতিক ধাঁচের নকশায় ঢাকাই জামদানী শাড়িতে ফুটে ওঠে চালতা পাড়, করলা পাড়, নিমপাত জাল, বেলপাতা পাড়, চন্দ্র পাড়, ঝাউ পাড়, শাল পাড়। একইসাথে তাঁতির সুনিপুন হস্তচালনায় ও মাকুর উঠানামায় শাড়ির জমিন জুড়ে ফুটে ওঠে আশফুল, পুঁই লতা, আম মৌর, জুঁই বুটি, বাঘ নলি বুটি, ইয়াররিং ফুল, নিমপাত, আঙ্গুল তেরছির মতো অপূর্ব সব নকশা।
ঐতিহ্যগতভাবেই ঢাকাই জামদানীর কারিগররা অত্যন্ত দক্ষ হাতে জামদানী শাড়ি বুনন করে আসছেন। জামদানী তাঁতিদের বয়নের এই অতুলনীয় পদ্ধতিকে ইউনেস্কো ‘ইনট্যাঞ্জিবল কালচারাল হেরিটেজ’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। আর এই স্বীকৃতির কল্যাণে সতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের জামদানী শাড়িগুলো বাঙালীসহ বিশ্বের রুচিশীল শাড়িপ্রেমীদের মনে বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছে।
দক্ষ কারীগরের অভাব, সুতার দুস্প্রাপ্যতা, কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধি ও প্রচার-প্রচারণার অভাবসহ আরও নানাবিধ কারনে শত বছরের ঐতিহ্যবাহী জামদানী এক সময় প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছিল। পরবর্তীতে জামদানির পুনর্জাগরণের উদ্যোগ নেয়া হয় গত শতাব্দীর আশির দশকে। সে সময় জামদানী শিল্পের সামাজিক সমস্যাগুলোর সমাধানে আড়ং, কুমুদিনী, অরণ্য এবং টাঙ্গাইল শাড়ি কুটিরের মতো দেশীয় খ্যাতনামা ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো কাজ করতে শুরু করলে জামদানীর বাজারে পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগে। পাশাপাশি প্রবাসী বাঙালীসহ বিদেশের বাজারেও রপ্তানী হতে শুরু করে জামদানী শাড়ি।
তবে জামদানী শাড়ি নিয়ে সাধারণ ক্রেতাদের মাঝে বেশ কিছু ভুল ধারনা এখনও বিদ্যমান। বিশেষ করে জামদানী শাড়ির রক্ষণাবেক্ষণে শাড়িতে কাটাওয়াশের প্রয়োজনীয়তাসহ এর সংরক্ষন ও সঠিক মূল্যে মানসম্মত শাড়ি চেনার বিভিন্ন কৌশল সম্পর্কে সাধারন ক্রেতাদের অনেকেই অবগত নন। এ সমস্যার সমাধানে জামদানী উদ্যোক্তাদের অনলাইনে প্রচার-প্রচারণা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে সাম্প্রতিক সময়ে। বর্তমানে অনলাইনে দেশীয় জামদানীর ব্যাপক প্রচার ও প্রচারণার কল্যাণে জামদানী শাড়ি সম্পর্কে ক্রেতাসাধারণের মাঝে নতুন করে আগ্রহ তৈরি হয়েছে। ফলে জামদানী সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তারা জানতে পারছে যা জামদানী শিল্পের সার্বিক অগ্রগতিকে আরও ত্বরান্বিত করবে।
লেখিকাঃ