Silk basically an animal protein Fiber- যা রেশম মথ, বাটারফ্লাই বা এ ধরনের পতঙ্গের লার্ভার কোকুন বা গুটি থেকে তৈরি হয়। এই মথগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিচিত এবং জনপ্রিয় প্রজাতি বোমবিক্স মোরি। এ ধরনের রেশম মথ মালভেরি বা তুঁত পাতা খেতে খুব পছন্দ করে এবং এই ধরণের রেশম পোকা থেকেই তৈরি হয় মালভেরি সিল্ক।
সিল্ককে বলা হয় “কুইন অব ফাইবার”।
- সিল্কের ইতিহাসঃ
সিল্কের ইতিহাস অনেক বছরের পুরোনো। এর উৎপত্তি হয়েছিল ৪০০০ খ্রীস্টপূর্বাব্দে নিউলিথিক যুগে চীনের ইয়াংশাও সভ্যতার
মাঝে। এই সময়ে মানব সভ্যতায় বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছিল বোঞ্জ যুগের সূচনা এবং লেখার উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে। বুঝতেই পারছেন সিল্কের উদ্ভাবন ইতিহাস কত বেশি পুরোনো! শুধু পুরোনোই না সিল্কের ইতিহাসের সাথে অনেক ইন্টারেস্টিং বিষয়ও জড়িত।
প্রথমত আশ্চর্য বিষয় হল, বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ এবং উন্নত এই সিল্ক ফেব্রিক আবিষ্কারের গোপনীয়তা রক্ষা করেছিল চীন প্রায় ৩হাজার বছর। অর্থাৎ ৩হাজার বছর এই সিল্কের কথা চীনের মানুষ ছাড়া বাইরের কেউ জানত না। এরপর ১১৪ খ্রীস্টপূর্বাব্দে চীনের বিখ্যাত “সিল্ক রোড” উন্মুক্ত হওয়ার পরই বিশ্বের অন্যান্য স্থানে এই ফেব্রিক ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করেছিল। এরপরও আরও হাজার বছর বিশ্বের সিল্ক উৎপাদন এবং বানিজ্যে চীনের এক চেটিয়া আধিপত্য বিরাজমান ছিল। সিল্ক তখন চীনে শুধু পোশাক হিসেবেই ব্যবহার হত না, লেখা নথিভুক্ত করাসহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজেও এর ব্যবহার হত।
সিল্ক আবিষ্কারক- কিংবদন্তি সম্রাজ্ঞী সি-লিং শিঃ
সিল্ক আবিষ্কারের গল্পটা কিন্তু বেশ মজার। যদিও এ নিয়ে অনেক গল্প প্রচলিত আছে, তবে চীনের পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে এবং চীনা দার্শনিক ও রাজনীতিবিদ কনফুসিয়াসের লেখার মাধ্যমে জানা গিয়েছে যে, রেশম বা সিল্ক চাষ এবং এর বুনন প্রথম আবিষ্কার করেছিলেন সম্রাজ্ঞী লেইজু (সি-লিং-শি নামে পরিচিত)।
গল্পটা এমন যে, সম্রাজ্ঞী লেইজু মালভেরি বা তুঁত গাছের নীচে বসে চা পান করছিলেন। হঠাৎ তার চায়ের কাপে একটা রেশম পোকার কোকুন বা গুটি এসে পরে। সম্রাজ্ঞী প্রথমে বিরক্তিবোধ করলেও হঠাৎ দেখেন, কোকুন থেকে সুতোর মত কিছু একটা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে যাচ্ছে। তিনি কৌতুহলী হয়ে চায়ের কাপ থেকে কোকুন উঠালেন এবং সুতা কোকুন থেকে আলাদা করতে করতে দেখলেন বিশাল লম্বা সোনালি ফাইবার এ থেকে তৈরি হয়েছে। সম্রাজ্ঞী তখন সেই সুতা দিয়ে বুনন করার সিদ্ধান্ত নেন এবং সম্রাটের সাথে পরামর্শ করে রেশম পোকার জীবনচক্র পর্যবেক্ষণ করেন। এরপর এর সম্ভাবনা বুঝতে পেরে তিনি তার সহচরীদেরকে রেশম চাষের আদেশ দেন। সেই থেকেই সম্রাজ্ঞী সি-লিং-শি হয়ে উঠেন চীনা পুরাণের “রেশমের দেবী“।
চীনে তখন শুধু মহিলাদেরই রেশম চাষের অনুমতি ছিল এবং অনেক মহিলাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা এই সিল্ক ইন্ডাস্ট্রিতে হয়েছিল।
আরও কথিত আছে যে, দীর্ঘ ৩হাজার বছর গোপন রাখার পর এই সিল্ক চীনের বাইরে যায় প্রথম খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে চীনেরই এক রাজকন্যার মাধ্যমে। রাজকন্যার বিয়ে হয় অন্য রাজ্যের রাজপুত্রের সাথে এবং তিনি জেদ করেন তার প্রিয় সিল্ক পোশাক ছাড়া তিনি যাবেন না। তাই তার মাধ্যমেই প্রথম চীন ছেড়ে রেশম বাইরে পাড়ি জমায় কঠিন নিষেধাজ্ঞা ভেঙে।
এরপর থেকে চীন সারাবিশ্বে রেশম রপ্তানী করতে শুরু করে সিল্ক রোডের মাধ্যমে, কিন্তু রেশম চাষের রহস্য খুব সতর্কতার সাথে তারা আরও এক হাজার বছর গোপন রাখতে সক্ষম হয়েছিল। রোমানরা এই সিল্কের বিশাল ভক্ত ছিল। সিল্ক রোডের মাধ্যমে চীন তখন প্রাচীন গ্রী, মিশর এবং রোমান সাম্রাজ্যে সিল্ক রপ্তানী করে আধিপত্য বিস্তার করেছিল। স্বর্ণের চেয়েও দামি ছিল তখন সিল্কের পোশাক।
বাংলায় সিল্কের আধিপত্যঃ
বাংলায় ঠিক কবে থেকে এবং কিভাবে সিল্ক বা রেশমের যাত্রা শুরু হয়েছে, তার সঠিক ইতিহাস জানা যায় নি। তবে চীনের সিল্ক রোডের মাধ্যমেই প্রথম হিমালয়ের পাদদেশের অঞ্চলগুলোতে সিল্কের চাষ শুরু হয়েছিল যা পরবর্তীতে ভারত এবং বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে বিস্তার লাভ করেছিল বলে জানা গেছে। এই অঞ্চলের রেশমের ঐতিহ্যের অন্যতম প্রধান কেন্দ্রবিন্দু ছিল রাজশাহী, মুর্শিদাবাদ এবং মালদা। এই ইতিহাস কয়েক’শ বছরের পুরোনো হলেও পর্যাপ্ত তথ্যের অভাব রয়েছে। বিভিন্ন ঐতিহাসিকের লেখার খন্ড খন্ড অংশ থেকে ধারণা করা যায়, ত্রয়োদশ শতকেই বাংলার রেশম বিশ্বজয় করেছিল এবং ইউরোপে এটি “বেঙ্গল সিল্ক” বা “গাঙেয় সিল্ক” নামে বেশ পরিচিতি লাভ করেছিল।
সেই ত্রয়োদশ শতকের বাংলার সিল্কের গৌরবান্বিত ইতিহাস আমাদের কাছে অস্পষ্ট হলেও ১৬শ শতক থেকে এর ইতিহাস বেশ স্পষ্টভাবেই আমরা পেয়েছি। কারণ তখন থেকেই বাংলার সিল্কের টানে ইউরোপীয়রা এদেশে ছুটে আসে বানিজ্য করতে। রাজশাহী, মালদা এবং মুর্শিদাবাদ এই তিন অঞ্চলের রেশম শিল্পকে কেন্দ্র করে ইউরোপের ওলন্দাজ, ফরাসি, পর্তুগীজ, ইংরেজ এবং আর্মেনিয়রা আসতে থাকে এদেশে। ১৬৫৮ সালে তারা ভাগীরথী তীরবর্তী কাশিমবাজারে রেশমের সবচেয়ে বড় বানিজ্যিক কুঠি নির্মান করে এবং উৎপন্ন রেশম সুতা ও কাপড় বিভিন্ন গ্রাম থেকে সংগ্রহ করে প্রচুর পরিমাণে ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে রপ্তানী করে।
বাংলার রেশমের ইতিহাস জানার পাশাপাশি আমরা এ অঞ্চলের ইতিহাসও স্বল্প পরিসরে জেনে যাব। ১৭২২ সালে বাংলার প্রথম স্বাধীন নবাব মুর্শিদকুলী খাঁ সমগ্র বাংলাকে মোট ২৫টি জমিদারিতে বিভক্ত করেছিলেন এবং রাজশাহীর জমিদারি ছিল এগুলোর মাঝে অন্যতম। ধীরে ধীরে রাজশাহী’র এই জমিদারি ১২ হাজার ৯০৯ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে বিস্তার লাভ করেছিল। ১৭৬৫ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার দেওয়ানি লাভ করার পর যখন রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা লাভ করে, তখন ১৭৬৯ সাল থেকে তারা বাংলার জমিদারিগুলোর রাজস্ব আদায়ের পদক্ষেপ নেয়। সেই সময় রাজশাহীর জমিদারির সদর দপ্তর ছিল নাটোরে। ইংরেজরা তাদের রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে ১৭৮৬সালে জমিদারি অঞ্চলগুলোকে জেলা ঘোষনা করে এবং রাজশাহীও তখন জেলায় পরিণত হয় বিশাল অঞ্চল নিয়ে, যা ভারতের বর্তমান মুর্শিদাবাদ জেলার একটা বড় অংশসহ মালদার নবাবগঞ্জ ও গোমস্তাপুর উপজেলা এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
তখনকার সময়েই সেই সপ্তদশ অষ্টাদশ শতকে বিশাল এই রাজশাহী অঞ্চলের রেশম শিল্প অনেক বেশি সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল। মালদা’র কয়েকটি অঞ্চল এবং মুর্শিদাবাদের ভৈরব তীরবর্তী কিছু অঞ্চলে উৎপাদিত রেশমও তখন ঐতিহ্যবাহী রাজশাহী সিল্ক হিসেবেই দেশ বিদেশের বাজারে পরিচিত ছিল, এই অঞ্চলগুলো তখন রাজশাহী জেলার অন্তর্ভুক্ত থাকায়।
১৮১৩ সালে রাজশাহী ও দিনাজপুর জেলার বিভিন্ন থানা এবং পুর্নিয়ার সমন্বয়ে গড়ে তোলা হয় মালদা জেলা। সেই সময় মালদা জেলা রেশম উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি সমৃদ্ধ হয়ে উঠে এবং খ্যাতি লাভ করে। এরপর ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর বাংলার ঐতিহ্যবাহী রেশম শিল্পে সমৃদ্ধ অঞ্চলগুলোও দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় এবং তখনকার সমৃদ্ধ রেশম উৎপাদন অঞ্চলগুলোর মাঝে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, শিবগঞ্জ, ভোলাহাট, রহনপুর থানাগুলো পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের রাজশাহী জেলার অন্তর্ভুক্ত হয়।
পরবর্তীতে তাই বেঙ্গল সিল্ক থেকে “রাজশাহী সিল্ক” এবং “মুর্শিদাবাদ সিল্ক” আলাদাভাবে অঞ্চলভিত্তিক পরিচিতি লাভ করে।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, প্রাচীনকাল থেকেই ভারতবর্ষের অন্য যে কোন স্থানের চেয়ে রাজশাহী জেলা রেশম এবং রেশমজাত পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানীতে শীর্ষস্থান দখল করে ছিল এবং পরবর্তীতে এটি মোগল সম্রাটদের পৃষ্ঠপোষকতায় অনেক বেশি সমৃদ্ধি লাভ করেছিল।
১৮শ শতক থেকে উনবিংশ শতক পর্যন্ত রাজশাহীর “বোয়ালিয়া” বন্দর ছিল উত্তরবঙ্গের একমাত্র বানিজ্যকেন্দ্র। তাই এ বন্দরকে কেন্দ্র করে গঙ্গা তথা পদ্মা তীরবর্তী অঞ্চলগুলোতে প্রচুর তুঁত চাষ করা হত রেশম শিল্পের জন্য এবং ওলন্দাজরা এখানে বানিজ্যিক কুঠিও নির্মাণ করেছিল। ১৮শ শতকে অসংখ্য রেশম শিল্পের কারখানা এবং বানিজ্য কুঠি ইউরোপীয়রা রাজশাহী অঞ্চলে তৈরি করেছিল, যার ২টি কুঠি পদ্মার গর্ভে বিলীনও হয়ে গেছে। জানা যায়, তৎকালীন রাজশাহী জেলায় ইউরোপীয় এবং দেশি কারখানাগুলোতে ৮-৯হাজার লোক প্রতিদিন রেশম গুটি থেকে সুতা তৈরি করত, প্রতি বছর ১৬-১৭ লাখ পাউন্ড মূলধন বিনিয়োগ হতো এবং ৫ হাজার মণ বা ১৮০টন র’সিল্ক বা কাঁচা রেশম উৎপাদিত হতো, যার মূল্য ছিল ৩৭ লাখ পাউন্ড।
ব্রিটিশ ঐতিহাসিক হান্টারের ভাষ্যমতে, “রাজশাহী জেলায় রেশম সুতা প্রস্তুত এবং রেশম বস্ত্র বয়ন বহু শতাব্দী পূর্ব থেকেই হয়ে আসছে।”
১৯১৬ সালে ব্রিটিশদের দ্বারা তৈরি রাজশাহী জেলার গ্যাজেটে তৎকালীন এ অঞ্চলের কালেক্টর ও’ম্যালা বলেছেন, “১৭৫৯ সালে মিস্টার হলওয়েল লিখেছেন, মোট ৬ ধরনের রেশম বস্ত্র এবং সুতা নাটোর থেকে ইউরোপসহ বসরা, মক্কা, জেদ্দা, পেগু, আচিন ও মালাক্কার বাজারে রপ্তানি করা হত।”
১৮১২ সালে প্রকাশিত Mr. James Grant’s Analysis of the Finances of Bengal নামে পরিচিত গন্থের ‘ফিফথ রিপোর্ট’ এ রাজশাহী সিল্ক সম্পর্কে লেখা হয়েছিল, ‘Rajeshahy, the most unwieldy extensive Zemindarry of Bengal, or perhaps in India; intersected in its whole length by the great Ganges or lesser branches, with many other navigable rivers and fertilizing waters, producing within the limit of its Jurisdiction, at least four-fifths of all the silk, raw or manufactured, used in or exported from the effeminate luxurious empire of Hindostan’.
উপরের এই ঐতিহাসিক দলিলগুলোই প্রমাণ করে কতটা গৌরবের ইতিহাস ছিল আমাদের রাজশাহী সিল্কের।
- বিভিন্ন ধরণের সিল্ক
প্রধানত সিল্ককে ২টা ক্যাটাগরিতে ভাগ করা যায়।
- ডোমিস্টিকেটেড বা কাল্টিভেটেড সিল্কঃ
মানুষ খামার করে মালভেরি বা তুঁথ গাছের। সেই গাছগুলোতে রেশম মথ বা এ জাতীয় পোকার চাষ করা হয়। তুঁত পাতা খেয়ে রেশম মথ কোকুন বা গুটি তৈরি করে থাকে। এই গুটি থেকে যে সিল্ক সুতা তৈরি হয়, তাকে মালভেরি সিল্ক বলে। এটা হিউম্যান কন্ট্রোলড প্রসেস। মালভেরি সিল্ককে আমরা কাতান সিল্ক বলেও জানি।
মটকা সিল্কও এই মালভেরি সিল্ক প্রসেস করার সময় বেঁচে যাওয়া সুতা থেকে বা ছিদ্রায়িত ড্যামেজড কোকুন থেকে তৈরি হয়।
- ওয়াইল্ড সিল্কঃ
বন-জঙ্গল থেকে ন্যাচারাল ওয়েতে যখন রেশম পোকার কোকুন বা গুটি সংগ্রহ করা হয় এবং সেগুলো থেকে সুতা কালেক্ট করা হয়, সেগুলোকে তখন ওয়াইল্ড সিল্ক বলা হয়।
ওয়াইল্ড সিল্কের মাঝে সবচেয়ে রেয়ার এবং বেস্ট কোয়ালিটির সিল্ককে বলে মুগা সিল্ক। মুগা সিল্কের শাড়ির এতোই দাম যে সাধারণ মানুষের সাধ্যের বাইরে। এছাড়া এরি/এন্ডি সিল্ক, তসর সিল্ক এগুলোও ওয়াইল্ড বা সেমি ওয়াইল্ড সিল্কের অন্তর্ভুক্ত।
- সিল্ক বুননের সুতার উপর নির্ভর করে ২ধরনের হয়।
১) Reeled Silk Yarn: (ফিলামেন্ট সিল্ক)
ফিলামেন্ট সিল্ক সুতা রেশম গুটির পরিপূর্ণ একেকটা কোকুন থেকে তৈরি হয় রিলিং প্রসেসের মাধ্যমে। এগুলো থেকে সর্বোচ্চ ভালো মানের সিল্ক ফেব্রিক এবং শাড়িগুলো তৈরি হয়।
রিলিং হচ্ছে একটা প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ একটা রেশম গুটি থেকে ধারাবাহিক সিল্ক ফিলামেন্ট পাওয়া যায়, যা আবার অন্য একটা কিছুতে প্যাঁচানো হয়। রেশম গুটি থেকে খুব সাবধানে সুতাকে আলাদা করতে হয়। সফলভাবে গুটি থেকে সুতাকে আলাদা করার প্রক্রিয়াটি অবশ্যই খুব নিঁখুত হতে হবে, কোন রকম ঝাঁকুনি না দিয়ে বা দিক পরিবর্তন না করে। কারণ খুব দ্রুত রেশম ফেব্রিক ভেঙ্গে যায়, আবার খুব ধীরে সুতাগুলো একটা আরেকটার সাথে জোড়া লাগে।
এই রিলিং প্রক্রিয়া খুব সাধারণ যন্ত্রের মাধ্যমে সম্পূর্ণ হাতেও করা যায়, আবার এখন অনেক আধুনিক যন্ত্রও রিল করার জন্য রয়েছে।
রিল্ড সিল্ক অনেক বেশি জনপ্রিয়, কারণ ধারাবাহিক সুতা পাওয়া যাওয়ার কারণে এটি অনেক বেশি মজবুত এবং টেকসই, যা থেকে সর্বোচ্চ কোয়ালিটির সিল্ক ফেব্রিক তৈরি করা সম্ভব হয়।
২) Spun Silk Yarn:
রেশম পোকা কোকুন বা গুটি থেকে যখন ছিদ্র করে বেরিয়ে যায় অথবা অন্য কোনভাবে কোকুন ড্যামেজ বা নষ্ট হয়, তখন সেটা থেকে ধারাবাহিক ভাবে লম্বা ফিলামেন্ট তৈরি করা যায় না। সুতা তখন ভাঙা ভাঙা অংশ হয়ে থাকে। সেই খন্ড খন্ড অংশকে যে কোন স্পিনিং মেশিং, হ্যান্ড স্পিনিং যন্ত্র বা চরকার মাধ্যমে জোড়া দিয়ে দিয়ে লম্বা সুতায় রূপ দেয়া হয়। এগুলোই স্পান সিল্ক সুতা।
স্পান সিল্ক সুতা থেকে তৈরি ফেব্রিক তৈরি হয়, সেগুলোর স্থিতিস্থাপকতা কম হয়, গ্লেসি কম হয়। তাই এগুলোর দামও কম।
বাংলাদেশ, ভারতসহ ভারতীয় উপমহাদেশীয় অঞ্চলে সাধারণত যে সিল্কগুলো তৈরি হয়, সেগুলোর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি নিম্নে দেয়া হলঃ
রেশম পোকার প্রজাতির উপর ভিত্তি করে এই অঞ্চলে প্রধানত ৪ ধরণের সিল্ক তৈরি হয়ে থাকে।
১। মালভেরি সিল্কঃ
মালভেরি সিল্ক তৈরি হয় বমবিক্স বর্গের Bombyx Mori রেশম পোকার গুটি থেকে। এই পোকাগুলো মালবেরি বা তুঁতগাছের পাতা খেয়ে গুটি তৈরি করে।
২। এরি বা এন্ডি সিল্কঃ
এরি সিল্ক তৈরি হয় ফিলোসেমিয়া বর্গের সামিয়া রিসিনি প্রজাতির মথের গুটি থেকে। এই মথগুলো সাধারণত ক্যাস্টর গাছের পাতা খায়।
এরি একটি অসমীয়া শব্দ, যার অর্থ ক্যাস্টর বা রেড়ি। রেশম মথ যখন ক্যাস্টর পাতা খেয়ে কোকুন বা গুটি তৈরি করে, তখন তা থেকে তৈরি সুতাকে এরি বা এন্ডি সিল্ক বলা হয়। তবে এই পোকাগুলো ক্যাস্টর ছাড়া অন্য গাছের পাতাও খেয়ে থাকে।
মথগুলো কোকুন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরই এরি/এন্ডি সিল্ক সুতা প্রসেস করা হয়। তাই এটা থেকে ধারাবাহিক সুতা পাওয়া যায় না, স্পিনিং করতে হয়। এজন্য এই সুতাগুলো কিছুটা মোটা কিন্তু ঘন, সূক্ষ্ম এবং শক্তিশালী। এন্ডি সিল্ক সুতা বেশ টেকসই হয়। অন্য সিল্কের তুলনায় ভারী হওয়ায় এটি উল এবং কটন সুতার সাথেও খুব ভালো ভাবে মিশে যায়, তাই এ থেকে শীতের শাল ও অন্যান্য পোশাকও তৈরি করা হয়। এন্ডি সিল্কের অন্যতম বিশেষত্ব হচ্ছে, এটি শীতকালে উষ্ণ এবং গ্রীষ্মকালে শীতল অনুভূতি দেয়। একে তাই “all-weather fibre” ও বলা হয়। পরিবেশগত দিকেও এই সিল্কের গুরুত্ব অনেক। এছাড়াও এই সিল্কের পানি শোষন ক্ষমতা ভালো, গায়ের সাথে লেগে থাকে না, ত্বকের চুলকানির কারন হয় না।
এই সিল্ক প্রসেস করতে কার্বন নিঃসরণ কম হয়, কারণ এটি সম্পূর্ণ হাতে প্রসেস করতে হয়। পরিবেশগত দিকেও এই সিল্কের গুরুত্ব অনেক।
৩। মুগা সিল্কঃ
মুগা সিল্কের উৎপত্তি মূলত ভারতের আসাম থেকে এবং এটি আসামের জিআই পন্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে ২০০৭ সালে। মুগা সিল্ক যে প্রজাতির রেশম মথ থেকে হয়, তা শুধু আসামেই আছে এবং বর্তমানে এই প্রজাতি বিলুপ্ত প্রায়। বিশ্বের বিরল সিল্কের মাঝে অন্যতম এই মুগা সিল্ক। আগেকার যুগে এটি কেবল রাজা রানী এবং রাজ বংশের ব্যক্তিদের ব্যবহারের জন্যই সংরক্ষিত ছিল এবং ভারতবর্ষের বাইরেও এর জনপ্রিয়তা ছিল অনেক বেশি।
অন্য সিল্কের সাথে মুগা সিল্কের প্রধান পার্থক্য হল, ন্যাচারালি এর গোল্ডেন হলুদাভ রং। আসামের ভাষায় যেহেতু মুগা মানে হলুদ, তাই এর নাম হয়েছে মুগা সিল্ক।
মুগা সিল্ক তৈরি হয় “Antheraea assanensis” প্রজাতির রেশম কীটের কোকুন থেকে, যেগুলোকে সেমি ওয়াইল্ড ন্যাচারের মথ বলা যায়। এই পোকাগুলো সোম এবং সোঁয়ালু গাছের পাতা খায়। এরা এতোটাই সেনসেটিভ হয় যে, সামান্য দূষনও সহ্য করতে পারে না। আসামের পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার কারণেই তাই এই প্রজাতি বর্তমানে প্রায় বিলুপ্ত এবং ধারণা করা হয় এক সময় একেবারেই এই জাতের পোকা আসামেও আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।
মুগা সিল্কের বেশ কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এই সিল্ককে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রাকৃতিক সিল্ক সুতা বলা হয়। এটি যেহেতু ন্যাচারালি গোল্ডেন হলুদাভ রং এর তাই একে অন্য রং এ রূপ দিতে প্রথমে সাদা রং এ রূপ দিয়ে তারপর অন্য যে কোন রং করা যায়। প্রতিবার ধোঁয়ার পর মুগা সিল্কের ঔজ্জ্বল্য আরও বেড়ে যায়। সবচেয়ে আশ্চর্য বিষয় হল যে, মুগা সিল্কের কাপড়ের স্থায়িত্ব এতোই বেশি যে, সালফিউরিক এসিডের মত শক্তিশালি রাসায়নিকও এর কোন ক্ষতি করতে পারে না।
মুগা সিল্ক আসামে কবে থেকে তৈরি হয় জানা না গেলেও এর ইতিহাস যে অনেক বেশি প্রাচীন তা বেশ বোঝা যায়। কারণ বাল্মিকী’র রামায়ণে এবং কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র বইতে মুগা সিল্কের ইঙ্গিত এবং উল্লেখ পাওয়া গেছে।
৪। তসর সিল্কঃ
তসর সিল্ক এন্থেরা (Antheraea) গোত্রের বিভিন্ন প্রজাতির মথের লার্ভা থেকে তৈরি হয়। সংস্কৃতি ভাষায় একে কোষা সিল্ক বলা হয়। তসর যে সব প্রজাতির রেশম মথের কোকুন থেকে তৈরি হয়, সেই মথগুলো সাধারণত ওয়াইল্ড হয়ে থাকে। দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন জায়গায় এই প্রজাতির মথগুলো শাল, অর্জুন, জামুন ইত্যাদি গাছের পাতা খেয়ে থাকে, আবার কিছু প্রজাতি ওক গাছের পাতাও খায়। মথগুলোর খাবারের ভিন্নতার উপর সিল্কের কোয়ালিটি এবং ধরনও ভিন্ন হয়। বন থেকেই তসর সিল্কের মথগুলোর কোকুন সংগ্রহ করা হয়।
তসর সিল্ক এর ন্যাচারাল গাঢ় গোল্ডেন কালারের জন্য বিখ্যাত। তবে একে অন্যান্য কালারেও রূপ দেয়া হয় ডাইয়িং এর মাধ্যমে।
• মটকা সিল্কঃ
এটা বেঙ্গল সিল্কের একটা টাইপ হিসেবেই বেশ পরিচিত৷ এটি অমসৃন টাইপের সিল্ক, যাকে হ্যান্ড স্পান বা হাতে কাটা মালভেরি সিল্কও বলা যায়। একে Rough (অমসৃন), রুক্ষ তাঁত সিল্ক কাপড় বা handloom silk fabric.বলা যায়, যা বর্জ্য মালবেরি সিল্ক (বম্বিক্স মরি) থেকে তৈরি করা হয় এর গাম (সেরিসিন) অংশ না সরিয়ে।
রেশম মথ যখন কোকুন বা গুটি ছিদ্র করে বেরিয়ে আসে, তখন সেটা থেকে পরিপূর্ণ লম্বা সুতা পাওয়া যায় না। ছিদ্রের কারণে ফিলামেন্টের খন্ড খন্ড অংশ পাওয়া যায়। তখন সেই সব ছিদ্রযুক্ত কোকেনকে গরম পানিতে সিদ্ধ করা হয় খন্ডিত অংশগুলো একিভূত করার জন্য। সিদ্ধ করার পর সেই কোকেনগুলো থেকে প্রাপ্ত খন্ডিত ফিলামেন্টগুলো একসাথে হয়, তারপর সেগুলো থেকে চরকা বা হাতে তৈরি সুতা কাটার মেশিনের সাহায্য নিয়ে সুতা তৈরি করা হয়। এগুলোই মটকা সিল্ক সুতা।
মটকা নামকরণের কারণ হলো, ড্যামেজড কোকেনগুলো প্রথমে যে পাত্রে সিদ্ধ করা হয়, সেটাকে বাঙালিরা মটকা (মাটির তৈরি এক ধরনের পাত্র) বলে৷ মটকাতে কোকেকগুলো সিদ্ধ করার কারণেই এর এই নাম দেয়া হয়েছিল।
তবে মটকা সিল্কের আরেকটা সংজ্ঞা ইন্টারনেট ঘেঁটে পাওয়া গিয়েছে। উপরে দেয়া সংজ্ঞার সাথে এর মিল রয়েছে কিন্তু কিছুটা অমিলও রয়েছে। কনসেপ্ট সেইমই বলা যায়।
মটকা সিল্ক হচ্ছে অমসৃণ সিল্ক, যা তৈরি হয় সিল্কের ওয়াস্টেজ থেকে। মানে কোকেন থেকে সিল্ক সুতা তৈরির প্রসেসের সময় এবং তা থেকে কাপড় বোনার সময়ও ফিলামেন্টের কিছু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ বা উচ্ছিষ্ট থেকে যায়। যেগুলোকে পুণরায় চরকা বা যে কোন হাতের মেশিনের মাধ্যমে মাধ্যমে জোরা দিয়ে দিয়ে সুতা তৈরি করা হয়। এই সুতাগুলোকেও মটকা সিল্ক বলা হয়। মটকা সিল্ক সুতা ফিলামেন্ট জুরে জুরে তৈরি হওয়ার কারণেই এটা অমসৃণ হয় এবং কম গ্লেসি হয়।
মটকা কাপড় ছিল ভারতীয় উপমহাদেশে তৈরি এক ধরনের মোটা রেশম। এটি মূলত কর্ণাটক এবং কাশ্মীর রাজ্য থেকে প্রাপ্ত হয় এবং পশ্চিমবঙ্গের মালদা, মুর্শিদাবাদ জেলায়ও করা হয়। পশ্চিমবঙ্গের সুজাপুর গ্রাম, বাংলাদেশের ইসলামপুর গ্রাম এবং গুজরাটের দরিয়াপুর গ্রাম হল কয়েকটি সুপরিচিত মটকা রেশম উৎপাদনকারী গ্রাম।
মটকা সিল্ক তৈরিতে রেশম পোকা হত্যার প্রয়োজন হয় না বলে, এটি বৌদ্ধ এবং জৈন ধর্মের মানুষদের কাছে বেশি জনপ্রিয় ছিল। আমাদের রাজশাহী অঞ্চলের তাঁতিদের উৎপাদিত মটকা কাপড়ের ব্যাপক সুনাম ছিল এক সময় এবং চাহিদাও ছিল। “ডাকরা মটকা” নামে একটি স্থানীয় মটকা কাপড় এতই উন্নতমানের ছিল যে, এটি রিলড সিল্কের সাথে তুলনীয় ছিল। তাঁতিরা মাঝে মাঝে মটকা সিল্ককে “খামরু” নামক অন্য ধরণের সিল্কের সাথে একত্রিত করে আরও উন্নত মটকা কাপড় তৈরি করে বলে জানতে পেরেছি।
- কোরা সিল্কঃ
কোরা মানেই ন্যাচারাল কালার। অর্থাৎ ডিগামিং প্রসেস না করে সরাসরি কোকুন থেকে সংগ্রহীত যে Raw Silk সুতাকে আমরা অরগাঞ্জা বলছি, এই অরগাঞ্জা সুতা কিন্তু কোন রকম ডায়িং বা রং করা ছাড়া এর প্রাকৃতিক রূপে থাকে। এই কালারলেস সুতা দিয়ে বোনা ফেব্রিকই হল কোরা সিল্ক। মানে সিল্ক তার নিজস্ব কালারে যখন থাকে, সেটাই হল কোরা সিল্ক। অনেকে বিভিন্ন কালারের শাড়িকে কোরা সিল্ক শাড়ি বলে সেল করে থাকে, কিন্তু সিল্কের নিজস্ব বা ন্যাচারাল কালার ছাড়া কোরা সিল্ক শাড়ি অন্য কোন কালারের হতে পারে না।
- Ahimsa or Peace Silk:
যখন সিল্ক সুতা রেশম পোকাকে না মেরেই সংগ্রহ করা হয়, অর্থাৎ কোকুন সম্পূর্ণ করে এ থেকে রেশম পোকা বেরিয়ে যাওয়ার পর কোকুন প্রসেস করে সুতা তৈরি হলে, তখন সেটাকে Ahimsa Silk বা Peace Silk বলা হয়। এই সুতা থেকে তৈরি কাপড়কে “ফেব্রিক অব পিস” বলা হয়।
এটা মহাত্মা গান্ধীর ফিলোসফি বা দর্শন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তৈরি হয়েছিল।
(“Ahimsa is the highest duty. Even if we can not practice it in full. We must try to understand its spirits and retain as far as is humanly possible from violence.” – Mahatma Gandhi)
Ahimsa or Peace সিল্ক তৈরিতে কোন পোকাকে মারতে হয় না, কষ্ট দিতে হয় না। তাই এতে অমানবিক কোন ব্যাপার নেই। এই প্রসেস ফলো করে সিল্ক সুতা তৈরি হতে পারে যে কোন মথ থেকেই। যেমনঃ সেটা মালভেরি, তসর, মুগা বা এরি যে কোনটিই হতে পারে।
সাধারণত পূর্ণাঙ্গ একটা কোকুন থেকে ৬০০ থেকে এক হাজার মিটার পর্যন্তও লম্বা সিল্ক ফিলামেন্ট পাওয়া যায়। কিন্তু Ahimsa/peace সিল্ক তৈরির প্রসেসে যেহেতু কোকুন ছিদ্র করে পোকাকে বেরিয়ে যেতে দেয়া হয়, তাই সুতার ধারাবাহিকতা নষ্ট হয় এবং ফিলামেন্টের প্রায় ৮০% ই ড্যামেজ হয়ে যায়। তখন এই কোকুনগুলোকে ডিগামিং করে, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সুতাগুলোকে স্পিনিং করে জোড়া দিয়ে লম্বা সুতা তৈরি করা হয়। এরপর তা দিয়ে সিল্কের কাপড় বোনা হয়।
২০০১ সাল থেকে পিস সিল্কের বানিজ্যিক ব্যবহার শুরু হয়েছে ভারতে।
- দুপিয়ন/ধুপিয়ান সিল্ক(Dupion Silk):
ধুপিয়ান সিল্ক তৈরির ব্যাপারটা বেশ মজার। যখন দুটি মালভেরি রেশম পোকা পাশাপাশি অবস্থান থেকে কোকুন বানাতে শুরু করে, তখন দুটি কোকুন একটা আরেকটার সাথে লেগে যায়, অর্থাৎ জট পাকিয়ে যায়। এই সংযুক্ত কোকুনদ্বয়কে দেখতে অনেকটা লাভ শেইপের মতো মনে হয়। এমন সংযুক্ত কোকুন থেকে যখন রেশম সুতা রিল করা হয়, সেটাকেই বলে ধুপিয়ান সিল্ক। এই ধুপিয়ান নামটা এসেছে ইংরেজি ‘Dupe’ শব্দ থেকে। এই শব্দটি ব্যবহার করার কারণ হচ্ছে, দুটি আলাদা কোকুন তৈরির কথা থাকলেও তৈরি হয়েছে সংযুক্ত একটি কোকুন।
ধুপিয়ান সিল্ক সুতা কিছুটা মোটা আর অমসৃণ হয় এর কোকুনের গঠনের কারণে। যদিও প্রথমে এ ধরনের সংযুক্ত কোকুন ন্যাচারালি রেশম পোকারা তৈরি করত, কিন্তু পরবর্তীতে ইচ্ছে করেই অনেক রেশম উৎপাদনকারীরা কোকুন বানাতে শুরু করার আগে আগে দুটি রেশম পোকাকে জোড়ায় জোড়ায় এমন ভাবে সেট করে রাখে যেন তারা এমন সংযুক্ত কোকুন তৈরি করতে পারে।
তারপরও ধুপিয়ান সিল্ক খুব বেশি পর্যাপ্ত না যতটা আমরা মার্কেটে দেখতে পাই। ধুপিয়ান সিল্ক বলে অন্য সিল্কই বেশি বিক্রি হয়ে থাকে বাজারে।
- গরদ সিল্কঃ
গরদ শব্দটির অর্থ হলো ‘সাদা’। গরদ সিল্ক বলতে এমন রেশম সুতাকে বোঝায় যাকে অন্য কোন রং এ রূপান্তর করা হয় নি। র’সিল্ক বা কাঁচা রেশম সুতাকে সাবান, সোডার দ্রবণে ডিগামিং করা হলে সুতার রং সাদা বর্ণ ধারণ করে। এই সাদা বা আংশিক সাদা বা অফ হোয়াইট সুতা দিয়ে বোনা ফেব্রিককে বলা হয় গরদ সিল্ক ফেব্রিক।
আমাদের দেশ এবং পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে গরদ সিল্ক শাড়ি ভীষণ জনপ্রিয়। বিশেষ করে পুজোর সময় হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা গরদ সিল্ক শাড়ি খুব বেশি পরে থাকে।
গরদ শাড়িগুলোর বৈশিষ্ট্য হলো, এগুলোর পুরো জমিন হয় সাদা বা অফ হোয়াইট আর আঁচল ও পাড় হয় লাল রং এর। তবে বর্তমানে গরদ সিল্ক শাড়ির পাড়, আঁচলের রং এ অনেক বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। পুরো সাদা জমিনের শাড়িতে নীল, কমলা, বাদামী, কালো, সোনালি, ইত্যাদি বিভিন্ন রং এর পাড় ও আঁচল দেখা যায়। পাড়ে, আঁচলে কখনো কখনো বিভিন্ন ফ্লোরাল মোটিফ করা হয়ে থাকে, তবে জমিনে কখনো কোন ডিজাইন করা হয় না।
- কাতান সিল্কঃ
কাতান সিল্ক সম্পর্কে দুই ধরণের তথ্য ইন্টারনেটের বিভিন্ন সোর্স থেকে পাওয়া গিয়েছে।
একটি হলো, মালভেরি রেশম গুটি থেকে পাওয়া কাঁচা রেশম সুতাকে ডিগামিং করার পর অর্থাৎ কয়েক ঘণ্টা ধরে পানির ক্ষারীয় দ্রবনে সিদ্ধ করার পর সেরিসিন প্রোটিন মুক্ত এবং সিল্কি ফাইব্রোয়েন প্রোটিন যুক্ত যে সিল্কি সুতা পাওয়া যায়, সেটাকে বলা হয় কাতান।
অপরটি হলো, টুইস্টেট বা পাকানো রেশম সুতাকে বলা হয় কাতান সিল্ক। বেনারসি তৈরিতেও এই একই ধরণের পাকানো সুতা ব্যবহৃত হয় বলে বেনারসির অপর নাম বলা হয় কাতান।
• সিল্ক মানেই কি সিল্কি?
No, All silk is not Silky.
এটা নিয়ে যেহেতু অনেক প্রশ্ন আর কনফিউশন রয়েছে। তাই একটু বিশ্লেষণ করে বলছি।
সাধারণত মালভেরি বা তুঁত গাছে রেশম পোকা চাষ করা হয় সিস্টেমেটিক ওয়েতে। তখন রেশম মথগুলো তুঁত পাতা খেয়ে কোকুন বা গুটি তৈরি করতে থাকে। একটা নির্দিষ্ট সময় পর রেশম মথগুলো কোকুন ভেদ করে বাইরে বেরিয়ে আসে।
যদি মথগুলো বের হওয়ার আগেই পূর্ণাঙ্গ সেই রেশম গুটিগুলো সংগ্রহ করা হয় এবং ভেতরে মথ থাকা অবস্থায়ই গরম পানিতে সিদ্ধ করে ফাইবারগুলো আলাদা করা হয়। তাহলে যে পরিপূর্ণ দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট ফিলামেন্ট পাওয়া যায়। সেটাকেই বলা হয় মালভেরি সিল্ক। এই সিল্ক অনেক বেশি উন্নত, অনেক বেশি সিল্কি, টেকসই এবং আরামদায়ক।
এখন বলি এই মালভেরি সিল্ক কেন সিল্কি এবং উন্নত মানের।
মালভেরি সিল্কের কোকুন প্রধানত দুইটি প্রোটিন উপাদানে তৈরি। একটি ফাইব্রোয়েন এবং অপরটি সেরিসিন।
ফাইব্রোয়েন হল কোকুনের ভেতরের প্রোটিন আর এর উপরে সেরিসিন প্রোটিন আবরণ হিসেবে থাকে৷ সেরিসিনকে সিল্ক গামও বলা হয়।
প্রাথমিক অবস্থায় কোকুনকে কোন রকম প্রসেস করার আগেই এ থেকে ফাইবার রিল করা হলে অর্থাৎ কোকুন থেকে সুতা খুলে খুলে আলাদা করা হলে যা পাওয়া যায়, সেটা Raw Silk. এটা একদম অমসৃনই হয় এবং মোটেই সিল্কি হয় না। এই Raw সিল্ক ফাইবারকেই আমরা বলি অরগাঞ্জা। আমাদের ঐতিহ্যবাহী যে জামদানি, এটায় এই Raw Silk ফাইবার বা অরগাঞ্জা ব্যবহার করা হয় বলে জেনেছি যাতে ফাইব্রোয়েন এবং সেরিসিন উভয় প্রোটিনই বিদ্যমান থাকে।
এখন আসি, সিল্ক তাহলে কিভাবে এর সিল্কি বৈশিষ্ট্য লাভ করে এই বিষয়ে।
Raw Silk ফাইবারকে যখন কয়েক ঘণ্টা ধরে গরম পানিতে সিদ্ধ করা হয়, তখন ফাইবারের উপরের যে সেরিসিন আবরণটা থাকে সেটা রিমুভ হয়ে যায় এবং শুধু ভেতরের ফাইব্রোয়েন প্রোটিন থেকে যায়। এই প্রসেসকে বলা হয় ডিগামিং। ডিগামিং প্রসেসের পর ফাইবারে যে ফাইব্রোয়েন প্রোটিন থেকে যায়, সেটার বৈশিষ্ট্য হল সিল্কি। সেরিসিন সরে যাওয়ার ফলে ফাইব্রোয়েন উন্মুক্ত হয় বলেই সিল্ক ফাইবার তখন সিল্কি বৈশিষ্ট্য লাভ করে। অর্থাৎ সিল্ক সিল্কি হয় ফাইব্রোয়েন প্রোটিনের কারণে এবং এই সিল্কি ন্যাচারে একে রূপ দিতে হলে কয়েক ঘণ্টা ধরে একে তাপ দিয়ে সিদ্ধ করতে হয় পানিতে। আর এই প্রসেসে যেহেতু ফাইবার থেকে সেরিসিন দূর হয়ে যায়, তাই সিল্ক ফাইবার এর সিল্কি ন্যাচার পাওয়ার পাশাপাশি এক-তৃতীয়াংশের মত ওজনও হারায়। এই সিল্কি সিল্ক সুতা Raw Silk এর থেকে তাই অনেক বেশি দামি হয়।
সাধারণত বেশি ভাগ মানুষ এই সিল্কি সিল্ক সুতাকে সফট সিল্ক বলে থাকে, কিন্তু সঠিক নাম বলতে হলে একে ডিগাম সিল্ক বা কাতান সিল্ক বলতে হবে।
- শেষকথাঃ
আমাদের দেশে অনেক নামে এবং ডিজাইনে সিল্ক কাপড় তৈরি হয়। কোনটা পুরোপুরি পিউর ন্যাচারাল সিল্ক সুতায় বোনা হয়, আবার কোনটা আর্টিফিশিয়াল সিল্ক বা কটন বা খাদির সাথে ব্লেন্ড করে তৈরি হয়। টানা ও বাইনের সুতার ভিন্নতা এবং পাড়, আঁচল, জমিনের ডিজাইনের ভিন্নতা অনুযায়ী সেগুলোর নামও ভিন্ন হয়।
যেমনঃ আড়ং সফট সিল্ক এবং কটনের সংমিশ্রণে তৈরি করে জয়শ্রী সিল্ক, যা গরমে খুব আরামদায়ক অনুভূতি দেয়। এছাড়াও রাজশাহী সিল্ক তথা আমাদের দেশে উৎপাদিত সবচেয়ে ভালো মানের সিল্ক বলতে সবাই বলাকা সিল্কের কথা বলে সবার আগে। তবে এই বলাকা সিল্ক তৈরির সঠিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে কোথাও স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় নি। এছাড়াও বাংলাদেশে উৎপাদিত সিল্ক সম্পর্কিত তথ্যের বেশ ঘাটতি লক্ষ্য করা গিয়েছে, যা পূরন করার দিকে আমাদের মনযোগী হওয়া উচিত। এই তথ্যের যুগে ইন্টারনেটে দেশি সিল্ক নিয়ে পর্যাপ্ত তথ্য যত বেশি পাওয়া যাবে, এটি সিল্কের উদ্যোক্তা এবং ক্রেতা বৃদ্ধিতে তত বেশি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। তাই দেশের সিল্ক ইন্ডাস্ট্রির উন্নয়নে ইন্টারনেটে সিল্ক নিয়ে কন্টেন্ট তৈরিতে গুরুত্ব দেয়া উচিত এবং কিছু লোকের ডেডিকেটেড ভাবে এদিকটায় কাজ করতে হবে।
লেখিকাঃ
সিল্ক কাপড় শাড়ি নিয়ে এমন সুন্দর আর কোন পোষ্ট আমি পড়িনি। এক টানে মন দিয়ে পড়েছি। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত একই রকমের আকর্ষন ছিলো লেখায় যা আমাকে পড়ায়আগ্রহ তৈরি করেছে। চমৎকার উপস্থাপন। ধন্যবাদ আপুকে এতো সুন্দর লেখা উপহার দেওয়ার জন্য।
আপু পুরো আর্টিকেলে আমাদের কাছে খুবই অবাক করেছে তথ্যের ভান্ডার রয়েছে।
আমি অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নোট করেছি আলহামদুলিল্লাহ্
সিল্ক নিয়ে চমৎকার সব তথ্য জানতে পারলাম আপু আপনার পোস্ট পড়ে।
অনেক অনেক তথ্য সমৃদ্ধ সিল্ক সম্পর্কে।
অসাধারণভাবে সিল্কের যাবতীয় তথ্য তুলে ধরেছেন আপু। অশেষ কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ আপি
আপু, আপনার পুরো লেখাটা মন দিয়ে পড়ে সিল্কের আদ্যোপান্ত পুরো তথ্য পাবে যে কেউ। লেখাটা সিল্ক নিয়ে যেমন সমৃদ্ধ তেমনই সকল প্রশ্নের উত্তর রয়েছে এতে।