বেনারসি শাড়ির অপর নাম বলতে পারেন, বাঙালির উৎসবের শাড়ি বা বিয়ের শাড়ি। কারণ যুগ যুগ ধরে বিয়ে সহ বড় ধরণের যে কোন অনুষ্ঠানে বাঙালি এবং ভারতীয় নারীদের প্রথম পছন্দ হিসেবে বেনারসি শাড়িরই জয়জয়কার দেখতে পাওয়া যায়। বিশেষ করে বিয়ের প্রোগ্রামে কনে সহ উপস্থিত নারী অতিথিদের মাঝে বেশির ভাগেরই পরিধানশৈলীতে বেনারসি শাড়িই দৃশ্যমান হয় সবচেয়ে বেশি। আধুনিকতার ছোঁয়ায় অনেক কিছু বদলে গেলেও কিন্তু বেনারসির প্রতি মোটেও বাঙালির ভালোবাসা কমেনি। বেনারসির এতো জনপ্রিয়তা এবং বিয়ের মতো প্রোগ্রামে এর প্রাধান্যের অন্যতম কারণ বেনারসির অসম্ভব গর্জিয়াস ডিজাইন। বেনারসি মানেই আসলে সূক্ষ্ম কারুকার্যমন্ডিত মোস্ট গর্জিয়াস বাঙালি শাড়ি। তাই প্রায় প্রতিটি বাঙালি মেয়ে কখনো না কখনো স্বপ্ন দেখে বেনারসি বধু হবার।
বেনারসি শাড়ির প্রারম্ভযাত্রা ও ইতিহাসঃ
বেনারসির উৎপত্তি মুঘল আমলে ভারতের বেনারস প্রদেশে। এটি ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম সেরা শাড়ি বলেই পরিচিত হয়ে এসেছে সেই সময়কাল থেকেই৷ কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, পাণিণির রচনা, ফ্রাঁসোয়া তেভারনিয়েরের বিবরণসহ আরও অনেক প্রাচীন গ্রন্থে বেনারসি বস্ত্রের উল্লেখ পাওয়া গিয়েছে।
১৬০৩ সালে দুর্ভিক্ষের সময় ভারতের গুজরাট থেকে সিল্ক বা রেশম তাঁতিরা স্থানান্তরিত হয়েছিল বেনারস প্রদেশে এবং সেখানেই তাদের হাত ধরে মুঘল সম্রাটদের চাহিদা অনুযায়ী এবং পৃষ্ঠপোষকতায় বেনারসি শাড়ি সমৃদ্ধিময় যাত্রা শুরু হয়েছিল।
যতদূর জানা গেছে, বেনারসি শিল্পের যাত্রা শুরু হয়েছিল আনসার সম্প্রদায়ের মুসলিম তাঁতিদের হাত ধরে, যারা এক সময় পারস্য থেকে ভারতে এসেছিল। জানা যায়, এই আনসার সম্প্রদায়ের পূর্বপুরুষরাই ছিলেন মদীনার সেই সম্প্রদায়, যারা মহানবী (সঃ) কে মক্কা থেকে মদীনায় আসার পর আশ্রয় দিয়েছিলেন এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহন করে তা পরবর্তীতে প্রচার করতে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পরেছিলেন। বেনারসের সিংহভাগ তাঁতিরাই এই সম্প্রদায়ের লোক।
প্রথমে তাই ব্রোকেড বেনারসিতে পার্সিয়ানদের ফ্লোরাল মোটিফের ডিজাইনগুলোই স্থান করে নিয়েছিল এবং মন জয় করেছিল মুঘল সম্রাট সম্রাজ্ঞীদের।
বাংলাদেশে বেনারসি’র আগমন ইতিহাস এবং অগ্রযাত্রাঃ
বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের তথ্য অনুসারে, বাংলায় বেনারসি তাঁতিদের আগমন ঘটে ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময়। সেই সময় প্রায় ৩০০ মুসলিম তাঁতি পরিবার এদেশে চলে এসেছিল। তারা মিরপুর ১০, ১১ ও পুরান ঢাকার মালিটোলা, বেচারাম দেউড়ি, কাজি আলাউদ্দিন রোড, নিমতলি, লালমোহন স্ট্রীট, কায়েৎটুলি, দয়াগঞ্জ, গেন্ডারিয়া, নবাবপুর, টেকেরহাট ও হুসেন মার্কেট প্রভৃতি জায়গায় তাদের আবাস গড়ে তুলেছিল।
এই তাঁতিদের মাঝে প্রথমে হারুন শেঠ নামের একজন প্রথমে এদেশে মোহনীয় এই বেনারসি বুনতে শুরু করেছিল। এরপর একে একে আরও কয়েকজন তাঁতি তার সাথে যোগ দিয়ে গড়ে তুলেছিলেন ছোটখাটো একটা বেনারসির রাজ্য। তাদের হাতে তৈরি সুনিপুণ বুনন কৌশলে তৈরি অপূর্ব সব ডিজাইনের কারণে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান, পশ্চিম-পাকিস্তান সহ অন্যান্য দেশেও এদেশে তৈরি বেনারসির সুনাম ছড়িয়ে পরে। এমনকি ভারতের বেনারসে এর জন্মস্থান হলেও এদেশের তাঁতিদের তৈরি বেনারসি ভারতেও প্রচুর রপ্তানি হত তখন। আস্তে ধীরে এসব তাঁতিদের থেকে বিহারি মুসলিম ও বাঙালিরাও বেনারসির বুননশৈলি রপ্ত করে এবং বড় হতে থাকে এভাবে এই শিল্প।
যাত্রা শুরুর পর অনেক বছর বেশ ভালো ভাবে এই বেনারসি শিল্পের বিস্তৃতি ঘটলেও ১৯৭১ সালের যুদ্ধকালীন অবস্থায় বেনারসি তাঁতিরা অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হোন। তবে বাংলাদেশে বেনারসি শিল্পের প্রকৃত বিকাশও শুরু হয় স্বাধীনতার কিছুদিন পর থেকে। এর আগে পর্যন্ত বেনারসি শিল্পে কাজ করা তাঁতিদের বেশির ভাগই ছিল ভারতের বেনারস থেকে আগত তাঁতিরা। কিন্তু স্বাধীনতার পর এদেশের অনেক মানুষ কাজের অভাবে তাঁতি হিসেবে জীবীকা নির্বাহের জন্য বেনারসি শিল্পের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে যায়। এভাবে তাঁতিদের সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে পুরান ঢাকায় থাকা বেনারসির তাঁতগুলো সরিয়ে মিরপুরে নিয়ে আসা হয় এবং মিরপুর ১০, ১১ ও ১২ নম্বরে গড়ে উঠে ‘মিরপুর বেনারসি পল্লি’।
আমাদের দেশের এই বেনারসি শিল্পের বয়স খুব বেশি না হলেও, কমও নয়। এই সময়ের মাঝে অনেক উত্থান-পতন এই শিল্পের হয়েছে। বেশ কয়েক বছর ধরে এদেশে বিদেশি পোশাকের আগ্রাসন বেড়ে যাওয়ায়, ভারত থেকে কম মূল্যের পাওয়ারলুমে তৈরী বেমারসিতে বাজার সয়লাভ হওয়ায় এদেশের তাঁতিদের হাতের নিপুনতায় তৈরি বেনারসির শিল্পে অনেকটাই ধ্বস নেমেছে।
১৯৯০ সালে তাঁত বোর্ডের করা এক জরিপ অনুসারে, সেই বছর মিরপুর বেনারসি পল্লিতে তাঁতি পরিবার ছিল ৮১৫টি এবং তাঁতের সংখ্যা ছিল প্রায় ৩,৯২০। আর ২০১৮ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর করা তাঁতশুমারীর তথ্য অনুযায়ী, মাত্র ২৮ বছরের ব্যবধানে মিরপুর এলাকার বেনারসি তাঁতি পরিবারের সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৬৯২ এবং তাঁত সংখ্যা ২,২২৩টি কমে দাঁড়িয়েছে ১,৮২৫টি তে। এগুলোর মধ্যেও আবার ২২৮টি তাঁতকল অকেজো অব্যবহৃত অবস্থায় পরে আছে। তাঁত বোর্ডের কর্মকর্তাদের মতে, অপরিকল্পিত আবাসনের কারণে অনেক তাঁতি পরিবার সিটি কর্পোরেশনের অভিযানে উচ্ছেদ হওয়ায় তাঁত পেশা ছেড়ে দিয়েছেন অনেকে, তাই এই অবস্থা।
যখন প্রথম এদেশে বেনারসি বুনতে শুরু করেছিলেন তাঁতিরা, তখন এই শাড়ির আলাদা কোন বিপণন ব্যবস্থা ছিল না। তাই ক্রেতারা সরাসরি তাঁতিদের থেকে সংগ্রহ করতেন এসব নান্দনিক ডিজাইনের বেনারসি শাড়ি। এরপর এর চাহিদা বাড়তে থাকায় ১৯৯৫ সালে ব্যবসায়ী ও তাঁতিদের যোগাযোগের সুবিধার্থে তৈরি হয় প্রথম প্রদর্শন কেন্দ্র।
বেনারসির বুনন গাঁথাঃ
সিল্ক আর জরি সুতোর মিশেলে নিঁখুত, সূক্ষ্ম কারুকাজের ভারি শাড়ি মানেই বেনারসি। ভালো মানের বেনারসি তৈরির প্রক্রিয়া বেশ জটিল, সময়সাপেক্ষ এবং ব্যয়বহুল। এক সময় বেনারসি তৈরির প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ সম্পন্ন হত তাঁতিদের সুকৌশলী হাতের ছোঁয়ায়। এরপর ঊনবিংশ শতাব্দীতে জ্যাকার্ড মেশিন আবিষ্কারের পর বেনারসিতে অপূর্ব সব নকশা তোলার কাজ অনেকটাই সহজ হয়েছে। পাশাপাশি সুতা রিল করা বা স্পান করার জন্যও হাতে ঘুরানো চরকার বদলে এখন বিভিন্ন মেশিনের ব্যবহার হচ্ছে।
আমাদের দেশে বেনারসি তৈরি করা হয় মূলত র’সিল্ক বা কাঁচা রেশম সুতা দিয়ে। রেশম সুতার উৎপাদন আমাদের দেশে অপর্যাপ্ত হওয়ায় বেনারসির কাঁচামাল এই সুতাগুলো আমদানি করা হয় চীন, ভারতসহ অন্যান্য দেশ থেকে। আমদানিকৃত সুতা প্রথমে রং করা হয়। এরপর এগুলোকে সাবান ও গরম পানির দ্রবনে ধুয়ে কারখানায় পাঠানো হয় কয়েকটি সুতা একসাথে করে টুইস্টিং করা বা পাকানোর জন্য।
অন্যদিকে বেনারসিতে কি ডিজাইন হবে, কি অপূর্ব নকশায় একে সাজানো হবে, সেই পরিকল্পনা করে গ্রাফমাস্টার নকশা তৈরি করেন। এরপর এই নকশা অনুযায়ী ছিদ্র করে করে পাঞ্চকার্ড তৈরি করা হয়। এই পাঞ্চকার্ডগুলো জ্যাকার্ড মেশিনে সেট করা হয় হ্যান্ডলুম বা পাওয়ারলুম তাঁত মেশিনের সাথে।
হ্যান্ডলুম মেশিনের মাধ্যমে তাঁতিরা টানা ও বাইনের সুতা দিয়ে অন্যান্য ফেব্রিক বোনার মতোই বেনারসি বুনে। তবে জ্যাকার্ড মেশিনের সেই পাঞ্চকার্ডগুলোতে আঁকা নকশাগুলোর মাধ্যমে শাড়িতে নকশা তোলার কাজ করে একই সাথে।
অন্যান্য শাড়ি তৈরির পদ্ধতির সাথে বেনারসির মূল পার্থক্য এটাই যে, এতে সিলভার এবং গোল্ডেন জরি সুতা ব্যবহৃত হয় কারুকায করার জন্য এবং হ্যান্ডলুম তাঁতে তাঁতি এই জরি সুতাকে সাপ্লিমেন্টারী বা সম্পূরক একটি এক্সট্রা বাইনের মাধ্যমে নকশা তোলায় ব্যবহার করে থাকে। এর জন্যই বেনারসি তৈরির পদ্ধতি অন্যান্য শাড়ি তৈরি থেকে জটিল।
একটি সাধারণ ডিজাইনের বেনারসি তৈরিতেও এক সপ্তাহ সময় লেগে যায়। আর এর ডিজাইনের ঘনত্ব ও সূক্ষ্ম নকশার জটিলতার উপর নির্ভর করে কত সময় লাগবে এটি তৈরি করতে। কখনো কখনো একেকটা ভারি কাজের বেনারসি শাড়ি তৈরিতে কয়েকমাস লেগে যায়।
বুনন কাজই কিন্তু শেষ না। এরপর বেনারসি শাড়িগুলোকে পলিশ করা হয় আলাদা কারখানায় এবং কিছু শাড়িকে আরও গর্জিয়াস করার জারদৌসির কাজ করা হয়, নকশার উপর বিভিন্ন স্টোন করা হয়। এই কাজগুলোর কারিগরও আলাদা।
বিভিন্ন ধরনের বেনারসি ফেব্রিক এবং শাড়িঃ
বেনারসি মূলত এর ভারি নকশার কারুকাজ এবং জটিল বুনন পদ্ধতির জন্যই এতোটা জনপ্রিয়। প্রথমদিকে বেনারসি শুধুমাত্র পিউর ন্যাচারাল সিল্ক দিয়েই বোনা হত সম্পূর্ণ হ্যান্ডলুমের মাধ্যমে। তাঁতিরা মাসের পর মাস একটা শাড়িতে সূক্ষ্ম ডিজাইন করেই কাটিয়ে দিতেন। কিন্তু বর্তমানে বেনারসি মূল কাঁচামালে অনেক ভিন্নতা এসেছে, ডিজাইন ও বুনন প্রক্রিয়াতেও অনেক পরিবর্তন এসেছে। সেই অনুযায়ী তাই অসংখ্য ক্যাটাগরি ও নতুন নাম আমরা বেনারসি শাড়ি ও ফেব্রিকের ক্ষেত্রে শুনতে পাই, তাছাড়া ডিজাইনের পাশাপাশি অঞ্চলভেদেও বেনারসি শাড়ির অনেক নতুন নাম এসেছে। ভারতের বেনারসে তৈরি শাড়িগুলোর নামের সাথে আমাদের দেশে তৈরি বেনারসির নামের পার্থক্য রয়েছে অনেক।
ফেব্রিকের বৈচিত্র্যতা অনুযায়ী প্রধানত বেনারসিকে ৪টি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছেঃ 1. Pure Silk or Katan, 2. Shattir, 3. Organza or Kora designed with Zari & Silk, and 4. Georgette.
এছাড়াও ডিজাইনের ভিন্নতা অনুযায়ী আলাদা করা হলে বেনারসি শাড়িগুলোকে জংলা, তানচোই, কাটওয়ার্ক, বুটিদার ও টিস্যু ইত্যাদি ভাগে ভাগ করা যায়।
Pure Silk or Katan:
বেনারসি শাড়ির কথা বললে সবার আগে আসবে কাতানের কথা। টানা ও বাইনে ধারাবাহিক লম্বা ফিলামেন্টের পিউর মালভেরি সিল্ক সুতায় তৈরি হয় এই কাতান বেনারসি। আর কাতানের বিশেষত্ব হল টু-প্লাই মালভেরি সিল্ক সুতা। অর্থাৎ দুইটা সিল্ক সুতাকে একসাথে টুইস্টিং মেশিনের সাহায্যে টুইস্ট করে বা পাকিয়ে একটা সুতা তৈরি করা হয়। তারপর সেই সুতাগুলো টানা আর বাইনে দিয়ে তৈরি করা হয় এই কাতান বেনারসি শাড়ি।
টুইস্ট করা সুতায় বোনা হওয়ায় কাতান বেনারসি বেশ মজবুত আর টেকসই হয়। আর পুরো শাড়ি একদম পিউর সিল্ক সুতায় বোনা হওয়ায় অনেক বেশি শাইনি, নরম এবং হাল্কা হয়। এই বৈশিষ্ট্যগুলোই কাতানকে সেরা শাড়ি হিসেবেই পরিচিত করেছে।
কাতান বেনারসিতে পুরো শাড়িতে ঘন নকশার বদলে সিলভার বা গোল্ডেন জরি সুতোর বিভিন্ন ফ্লোরাল বুটিদার, কলকা, জংলা ও লতাগুল্ম জাতীয় নকশাই বেশি দেখা যায়।
Shattir:
এই ধরনের বেনারসিকে প্রাচীন বেনারসির আধুনিক সংস্করণ বলা যায়। এই শাড়িগুলো সাধারণত কাতানের চেয়েও সিম্পল এবং হাল্কা ওজনের হয়, তবে যথেষ্ট এক্সক্লুসিভও হয়। মূলত প্রতিদিনের রেগুলার ইউজের উপযোগী করেই এগুলো তৈরি হয়, তাই দামও অন্যান্য বেনারসির তুলনায় বেশ রিজনেবল হয়ে থাকে।
Organza (Kora) with Zari and Silk:
কোন প্রকার ডাইয়িং এবং ডিগামিং করা ছাড়া সেরিসিন প্রোটিন আবরণযুক্ত একদম ন্যাচারাল কালার সিল্ক সুতাকেই আমরা অরগাঞ্জা বা কোরা সিল্ক বলে জানি। টানা ও বাইনে এ ধরনের সিল্ক সুতার সাথে যখন এক্সট্রা বাইনের সুতা হিসেবে সিলভার বা গোল্ডেন জরি সুতা ব্যবহার করে ব্রোকেড ডিজাইন করা হয়, তখন সেই ফেব্রিক বা শাড়িকে বলা হয় অরগাঞ্জা বা কোরা সিল্ক বেনারসি। ব্রোকেড হল এমন ধরনের বুনন কৌশল যা দেখতে এমব্রোয়ডারির মত মনে হয়। বেনারসিতে ব্রোকেড নকশাই অধিক প্রাচীন এবং জনপ্রিয়।
Georgette:
জর্জেট ফেব্রিকের বেনারসি শাড়ি হল, সবচেয়ে হাল্কা ম্যাটেরিয়ালে বোনা গর্জিয়াস শাড়ি। জর্জেট বেনারসি শাড়ি বোনা হয় ক্রেপ সুতা দিয়ে। যার জন্য এই শাড়িগুলো অত্যন্ত সূক্ষ্ম এবং হাল্কা ওজনের হয়ে থাকে, তাই যে কোন স্টাইলে সহজেই পরা যায়। ক্রেপ সুতার মূল বৈশিষ্ট্য হল, এগুলো অত্যধিক পাকানো সুতা। এই ক্রেপ সুতাগুলোই টানা এবং বাইন উভয় দিকে ব্যবহার করে এবং সাথে জরি সুতো দিয়ে নকশা তুলে জর্জেট বেনারসি শাড়ি তৈরি করা হয়।
ডিজাইনের ভিত্তিতে বেনারসির ক্যাটাগরিঃ
জংলাঃ
ব্রোকেড বেনারসিগুলোর মাঝে এই জংলা ডিজাইনকে সবচেয়ে প্রাচীন বলে মনে করা হয়। কালারফুল সিল্ক সুতায় এ ধরনের বেনারসি বুনন করা হয়। পুরো শাড়ি জুড়ে থাকে জালের মত বিস্তৃত জরি সুতার জটিল ও ঘন কারুকাজ, যেগুলোর মোটিফ হয় বিভিন্ন ফুল আর লতাপাতার মিশেলে। এ ধরনের শাড়ির বুনন পদ্ধতিকে কারুয়া বলা হয়।
এগুলোর পাড় এবং আঁচলে জটিল নকশার সাথে মিনাকারীও করা হয়।
শিকারগড়ঃ
জংলার মতো শিকারগড় বেনারসিতেও যে সব মোটিফ বা প্যাটার্নের নকশা করা হয়, সেগুলোও প্রকৃতি থেকে নেয়া বিভিন্ন উপাদান। তবে জংলা শাড়িতে ফুল, গাছ আর লতাপাতার নিদর্শন থাকলেও, শিকারগড় শাড়িতে থাকে শিকারের দৃশ্য এবং জঙ্গলের বিভিন্ন পশুদের আদলে চিত্রিত মোটিফ।
তাঞ্চইঃ
জটিল প্যাটার্নের ব্রোকেড বেনারসির মাঝে অন্যতম হল এই তাঞ্চই ডিজাইনের শাড়িগুলো। এই শাড়িগুলোর আঁচল বড় বড় প্যাসলে মোটিফে সজ্জিত হয় এবং বর্ডার তৈরি করা হয় সিম্পল ক্রিস-ক্রস প্যাটার্নে।
এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, ব্রোকেডের মাঝে জামেওয়ার স্টাইলের এই শাড়িগুলোর প্যাটার্নে জরি সুতা ব্যবহার করা হয় না, বিভিন্ন রং এর সিল্ক সুতা দিয়েই সূক্ষ্ম, বিস্তৃত প্যাটার্ন বা নকশাগুলো তোলা হয়। তাঞ্চই বেনারসির বুনন কৌশল এমন যে, এতে সিঙ্গেল বা ডাবল টানা দেয়া হয় এবং বাইনে ৫-৬টি কালারের সুতাও ব্যবহার করা হয়। এই শাড়িগুলো ওজনেও বেশ হালকা হয়।
বিভিন্ন ধরনের তাঞ্চই বেনারসি দেখতে পাওয়া যায়। এর মাঝে ফ্ল্যাট বুননের তাঞ্চই এমন হয় যে, শাড়ির উলটো পাশে একদমই কোন সুতা দেখা যায় না। আবার ফ্লট বুননের তাঞ্চই বেনারসির উলটো পাশে বাড়তি সুতা থাকে, যা বুনন শেষ করার পর কেটে দেয়া হয়। এছাড়াও আরও কয়েক ধরনের তাঞ্চই বেনারসিও বোনা হয়।
কাটওয়ার্ক শাড়িঃ
কাটওয়ার্ক টেকনিকে তৈরি বেনারসিগুলো এমন ভাবে তৈরি করা হয় যে, মোটিফগুলোকে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে এক্সট্রা বাইনের সুতার মাধ্যমে যুক্ত করে একের পর এক ডিজাইন তৈরি করা হয় এবং পরবর্তীতে এই ঝুলন্ত বাইনের সুতাগুলোকে কেটে ফেলা হয়। এই শাড়িগুলোকে জামদানির সস্তা সংস্করণও বলা হয়। এই শাড়িগুলোর বুননে টানার সুতায় একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ কটন সুতা যুক্ত করা হয় এবং বাইনের সুতা দিয়ে জটিল নকশা তোলা হয়। কাটওয়ার্ক শাড়িতে সাধারণত গাঁদা ফুল, জুঁই ফুল আর লতা-পাতার মোটিফে নকশা তোলা হয়।
টিস্যু বেনারসিঃ
বেনারসি শাড়িগুলোর মাঝে মোস্ট গ্লামারাস বলা যায় টিস্যু বেনারসিকে। এগুলোর বুননে বাইনে জরি সুতা ব্যবহার করায় অনেক বেশি গ্লেসি আর শাইনি হয়। টিস্যু বেনারসির বুননে টানায় সিল্ক সুতা, বাইনে গোল্ডেন জরি সুতা ব্যবহার করা হয় এবং এক্সট্রা বাইনে সিল্ক ও জরি সুতার মিশ্রনে নকশা তোলা হয়।
বুটিদার বেনারসিঃ
সিল্ক সুতায় বোনা বুটিদার শাড়ি জুড়ে থাকে সিল্ক, গোল্ডেন ও সিলভার জরি সুতার ঘন ব্রোকেট বুটিদার ডিজাইন। ব্রোকেডে গোল্ডেন সুতার ডার্ক শেড ও সিলভার সুতার হালকা শেডের কারণে, এই শাড়িগুলো গঙ্গা-যমুনা নামেও বিখ্যাত।
বুটিদার বেনারসিতে বিভিন্ন প্যাটার্নের ও নামের নকশা করা হয়, যেমন- জরি বুটি, লতাপাতা বুটি, আঙুর বুটি, আশরাফি বুটি, রেখা বুটি, ঝুমুর বুটি, বালুচর বুটি, লতিফা বুটি ইত্যাদি আরও অসংখ্য নাম রয়েছে।
বুটিদার বেনারসি আমরু ব্রোকেড শাড়ি নামেও পরিচিত এবং ছোট ছোট বিভিন্ন ফ্লোরাল মোটিফে একে সজ্জিত করা হয় বলে একে বুটিদার নাম দেয়া হয়েছে। বুটিদার শাড়ি আসলে ব্যয়বহুল কিংখাবের সস্তা সংস্করণ বলা যায়। কিংখাবের ব্রোকেড ডিজাইন এতোটাই ঘন হয় যে, উপরের ব্রোকেড ডিজাইনের জন্য শাড়ির বুননের ফেব্রিকের কালারই ম্লান হয়ে যায়, শাড়িতে ডিজাইনের বাইরে ফাঁকা জায়গা প্রায় থাকে না বললেই চলে। বুটিদারেও তাই নকশা অনেক ঘন হয়।
বাংলাদেশে তৈরি বেনারসি শাড়ির বৈচিত্র্যময় নকশা ও নামের সেকাল একালঃ
জানা যায়, শুরুর দিকে বেনারসির নকশার প্যাটার্ন বা মোটিফগুলো ছিল পার্সিয়ান ধাঁচের। এরপর আসে মুঘল মোটিফ। উনবিংশ শতাব্দীর আশির দশকে ঘরবাড়ি আর টেরাকোটার নকশা করা শাড়িগুলো বেশি জনপ্রিয় ছিল। এরপর নব্বই এর দশকে ক্রেতারা বেশি পছন্দ করত সামার কাতান, ওয়াল কালাম, টিস্যু, সুস্মিতা কাতান, সিলসিলা কাতান নামের বেনারসিগুলো। ২০০০ সালের দিকে রাঙুলি, কলকা, ওয়াল কালামের মধ্যে এসেছে অনেক নতুনত্ব আর বৈচিত্র্য।
বেনারসিগুলো পাড় ছাড়া, চিকন পাড় বা চওড়া পাড় যে কোন ডিজাইনেই হয়ে থাকে। কখনো পুরো শাড়িতে খুঁজে পাওয়া যায় ছড়ানো বিভিন্ন ধরনের বুটি, জংলা লতাপাতা, ছোট বড় কলকা অথবা শুধু বড় একটি ঝাড়। বেনারসিতে অসংখ্য ডিজাইন পর্যন্ত পাওয়া গেলেও আরও নতুনত্ব আনার চেষ্টা চালিয়েই যাচ্ছেন এর কারিগররা। তাই বেনারসিতে আলাদা ভাবে আবার ভেলভেটের পাড় লাগিয়েও ফিউশন আনা হচ্ছে বা স্ট্রাইপ করা মোটা পাড়ও দেয়া হচ্ছে। তবে শাড়ির জমিনে সোনালি রূপালি জরি সুতোর কারুকাজ থাকছেই। আবার কিছু কিছু নকশা জামদানি, টাঙ্গাইল ও পাবনার স্থানীয় নকশার সংমিশ্রণেও তৈরি হয়ে থাকে।
পাড় ছাড়া বুটিদার বেনারসি বা মিরপুর কাতানঃ
বাংলাদেশের বাজারে ১৯৯৫ সাল থেকে যুক্ত হয়েছিল পাড় ছাড়া শাড়ির জমিনে ছড়ানো বুটির নকশাযুক্ত বেনারসি শাড়ি। এগুলোর আঁচলে ঘন কারুকাজের পরিবর্তে হাল্কা কাজ করা হত। এই শাড়িগুলো তখন পুরোপুরি হাতে বোনা হত একদম পিউর সিল্ক সুতা দিয়ে আর বুটির নকশা তোলা হত রোলেক্স জরি সুতা দিয়ে। তবে ২০০০ সাল থেকে শাড়িগুলোতে চায়না সুতা ব্যবহার করা হচ্ছে এবং শাটল ও হ্যান্ডলুম তাঁত দুই এর মিশ্রনে এগুলো তৈরি হচ্ছে। সাধারণত একজন কারিগর দৈনিক একটি করে এই শাড়ি বুনতে পারেন। আর চায়না সুতা ব্যবহার করায় দামেও বেশ রিজনেবল। ১-৩ হাজার টাকায় বেনারসি পল্লির যে কোন দোকানে শাড়িগুলো খুঁজে পাওয়া যায়৷ এই শাড়িগুলো মিরপুরেই করা হয় বলে, এগুলোকে মিরপুর কাতান বলা হয়৷
মিরপুর কাতান শাড়িগুলো ৩০-৪০টির মতো রং এ পাওয়া যায়। দাম রিজনেবল হওয়ায় এগুলো উপহার হিসেবে দেয়ার জন্য এবং হলুদের প্রোগ্রামে পরার জন্য ক্রেতারা বেশি পছন্দ করেন বলে জানা গেছে। তবে শাড়িগুলো সব ধরনের প্রোগ্রামের জন্যই সমান উপযোগী। গাঢ় রং এর মিরপুর কাতানের সাথে একটু ভারি গয়না পরে যেমন জমকালো যে কোন প্রোগ্রামে যাওয়া যায়, আবার হালকা কালারের শাড়িগুলো পরেও স্নিগ্ধ সাজে যে কোন প্রোগ্রামে নিশ্চিন্তে উপস্থিত হওয়া যায়।
এছাড়াও বাংলাদেশে তৈরি বেনারসিগুলোর গুনগত মান, ব্যবহৃত সুতার ধরন এবং ডিজাইনের ভিন্নতা অনুসারে এমন অসংখ্য নাম দেয়া হয়। এ পর্যন্ত পাওয়া বেনারসির নামগুলো নিমরূপঃ
1. ফুলকলি কাতান,
2. দুলহান কাতান,
3. মিরপুরের রেশমি কাতান,
4. মিলেনিয়াম কাতান,
5. বেনারসি কসমস,
6. অরগেন্ডি কাতান,
7. ব্রোকেট কাতান,
8. রেশমি কাতান,
9. প্রিন্স কাতান
10. রিমঝিম কাতান,
11. টিস্যু কাতান,
12. মিরপুরি গিনি গোল্ড কাতান,
13. জর্জেট গিনি গোল্ড কাতান,
14. চুনরি কাতান
15. মসলিন বেনারসি,
16. নেট জুট বেনারসি,
17. কাতান বেনারসি,
18. মসলিন কাতান,
19. পিয়ান বেনারসি,
20. খাদি বেনারসি,
21. রাঙ্গুলি কাতান,
22. ওয়াল কালাস,
23. আহামনি কাতান,
24. তানিন বর্ডার,
25. সাটিন ব্রোকেড কাতান
26. চান্দেরি কাতান,
27. দুধ কাতান,
28. পিরামিড কাতান,
29. অতসি,
30. পূরবী,
31. সাটিন মিনা বাংলা পুঁতি কাতান
32. বিন্দিয়া বেনারসি
‘দেবদাস’ মুভিতে শরৎচন্দ্রের নায়িকারা যখন বাংলাদেশের বেনারসিতেঃ
বলিউড জগতের অন্যতম আলোচিত এবং সুপারহিট সিনেমা শরৎচন্দ্রের ‘দেবদাস’ উপন্যাস অবলম্বনে সঞ্জয় লীলা বানসালি পরিচালিত ‘দেবদাস’ মুভি। এতে ‘পারু ও চন্দ্রমুখী’ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন বলিউডের সিনেমা জগতের দুই সম্রাজ্ঞী ‘ঐশ্বরিয়া রাই এবং মাধুরী দীক্ষিত’। মুভিতে তাদের বাঙালি নারী চরিত্র আরও আকর্ষনীয় রূপে ফুটিয়ে তুলতে তাদের উভয়ই পরেছিলেন বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী মিরপুরের বেনারসি শাড়ি।
দেবদাসের ৩টা গানের জন্য বাংলাদেশ থেকে বেনারসি শাড়ি নেয়া হয়েছিল। ‘ডোলা রে ডোলা’ গানে ঐশ্বরিয়া মাধুরীর পরিধেয় লাল সাদা বেনারসি এবং ‘সিলসিলায়ে চাহাত কা’ ও ‘হামেশা তুমকো চাহা’ গানদুটিতে ঐশ্বরিয়ার পরিধেয় বেনারসি শাড়ি বাংলাদেশের মিরপুরের বেনারসি পল্লি থেকে নেয়া হয়েছে বলে জানা গিয়েছে।
বাংলাদেশের অঞ্চলভিত্তিক বেনারসি শিল্প ও তাদের বর্তমান অবস্থাঃ
বাংলাদেশে বেনারসি শিল্পের সমৃদ্ধ যাত্রা প্রথম ঢাকার মিরপুরে শুরু হলেও, এরপর এটি দেশের আরও কয়েকটি অঞ্চলেও বিস্তৃতি লাভ করে, যেমনঃ ঢাকার রাজবাড়ি, পাবনা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, রংপুর, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ প্রভৃতি এলাকায়ও বেনারসি তাঁত ও তাঁতিরা রয়েছে এবং গড়ে তুলেছে বেনারসি পল্লি।
মিরপুর বেনারসি পল্লিঃ
মিরপুর বেনারসি পল্লিতে প্রতি মাসে কমপক্ষে আড়াই কোটি টাকার শাড়ি বুনেন তাঁতিরা। সাধারণ জনসাধারণের সাধ্যের কথা চিন্তা করে এবং সব ধরনের কাস্টমার চাহিদা পূরণে তারা যেমন উচ্চমূল্যের পিউর সিল্কের উপর অনেক ভারি ও জটিল ডিজাইনের বেনারসি তৈরি করেন, তেমনি চায়না থেকে আমদানিকৃত বিভিন্ন কম দামের আর্টিফিশিয়াল সুতা দিয়েও বেনারসি বুনেন। প্রধানত পলিয়েস্টার সুতা দিয়ে কম দামি বেনারসি শাড়িগুলো তৈরি করেন তারা, যেগুলোর চাহিদা সবচেয়ে বেশি।
মিরপুর বেনারসি পল্লিতে বর্তমানে ৪ শতাধিক তাঁতি নিয়মিত শাড়ি বুনেন। প্রতিমাসে তারা গড়ে ১হাজার পিস পলিয়েস্টার সুতার শাড়ি তৈরি করেন। সব মিলিয়ে মাসে গড়ে আড়াই থেকে তিন কোটি টাকার শাড়ি তৈরি হয়। আর যেহেতু আমাদের দেশে বিয়ের মৌসুমে বেনারসি শাড়ির চাহিদা সবচেয়ে বেড়ে যায়, তাই সেই সময়টায় শাড়ি বিক্রিও হয় অনেক বেশি টাকার। বিয়ের মৌসুমে ৪ কোটি টাকার মতো মূল্যের শাড়ি তৈরি ও বিক্রি হয়।
বর্তমানে এই পল্লির অনেক তাঁতিদের পেশা ছেড়ে দেয়ার অন্যতম কারণ হল, এই অঞ্চলের জমির দাম ও বাসা ভাড়ার বৃদ্ধি। আবার অনেকে তাঁত যন্ত্রের শব্দের কারণেও তাঁতিদের বাসা ভাড়া দিতে চান না। অনেক তাঁতি তাই মিরপুর ছেড়ে অন্যান্য অঞ্চলেও পাড়ি জমিয়েছেন। পূর্বে এই অঞ্চলে বেনারসির সাথে যুক্ত কারিগর, সহকারি ও অন্যান্য কর্মচারি মিলিয়ে প্রায় ৪০ হাজারের বেশি লোক যুক্ত ছিল, যাদের প্রায় ৭৫ শতাংশই এখন এই পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। মিরপুরের তাঁতিরা তাই তাদের জন্য সঠিক পুনর্বাসন ব্যবস্থা আশা করেন। এসব তাঁতিদের কথা চিন্তা করেই বর্তমানে ৩০৭ কোটি টাকা ব্যয়ে মাদারীপুর ও শরীয়তপুর জেলার শিবচর ও জাজিরা উপজেলায় খোলামেলা পরিবেশে শেখ হাসিনা তাঁতপল্লি স্থাপনের প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে, যা সম্পন্ন হলে তাঁতিদের অনেক সমস্যার সমাধান হবে বলেই আশা করা যায়।
২০০০ সাল থেকে ভারতীয় পাওয়ারলুমে তৈরি শাড়ির সাথে পাল্লা দিয়ে পিছিয়েই পরছেন মিরপুর বেনারসি পল্লির তাঁতিরা। পাওয়ায়লুমে যে শাড়ি ২দিনে তৈরি হয়, সেটা আমাদের তাঁতিরা হ্যান্ডলুমে তৈরি করে দুই সপ্তাহে। এতে উৎপাদন খরচও অনেক বেশি হয় আমাদের তাঁতিদের, তাই শাড়ির দামও বেশি হয়। এজন্য ভারতের কম মূল্যের মেশিনে তৈরি শাড়ির দিকে বেশি ঝুঁকছে কাস্টমাররা। মিরপুর বেনারসিপল্লির শাড়ির দোকানগুলোও তাই এখন ভারতীয় কম মূল্যের বেনারসিতে সয়লাভ থাকে।
আমাদের টেক্সটাইল এবং তাঁত শিল্পের অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হল, কাঁচামাল প্রায় সবই আমদানি করতে হয়। মিরপুরের বেনারসি পল্লিতেও এর ব্যতিক্রম হয় নি। পিউর বেনারসি শাড়ির প্রধান উপাদান কাঁচা রেশম সুতা, যা আমাদের দেশে চাহিদা অনুযায়ী তৈরি হয় না বলে চীন, ভারত থেকে আমদানি করতে হয়। আর আর্টিফিশিয়াল সুতাগুলোও সব আমদানি করা হয় চীন থেকে। আর এখন সব ধরনের আমদানিকৃত সুতারই দাম বেড়েছে।
যেখানে ২০০০ সালের দিকে প্রতি কেজি পিউর চায়না সিল্ক সুতা কিনতেন তাঁতিরা ১১শ টাকা দিয়ে, এখন সেই সুতার দাম প্রায় ৮গুন বেড়ে পৌঁছেছে ৮হাজার টাকায়! কোভিড-১৯ আক্রমণের কারণে শিপমেন্ট বন্ধ থাকায়ও সুতার দাম বেড়ে গিয়েছে। একটা কাতান বেনারসি শাড়ি তৈরিতে ৪০০গ্রাম পিউর সিল্ক সুতা দরকার হয় এবং একটা মাত্র শাড়ি তৈরিতে উৎপাদন খরচ হয় ১২-১৭ হাজার টাকা! সর্বোচ্চ কোয়ালিটির এই শাড়িগুলোর দাম বেশি হওয়ায় তাই ক্রেতা কম। এজন্যই তাঁতিরা এখন আর্টিফিশিয়াল সুতা দিয়ে কম মূল্যের শাড়ি বানান এবং বেনারসি কাতান নামেই এগুলো বিক্রি করা হয়।
গাজীপুরের বেনারসি পল্লিঃ
গাজীপুরের টঙ্গীর অদূরে একটি এলাকায় ছোট পরিসরে আবাস গড়েছে বেনারসি তাঁতিরা এবং তাদের নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় তৈরি হচ্ছে অপূর্ব নকশার সব বেনারসি শাড়ি।
গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের অন্তর্ভুক্ত টঙ্গীর সাতাইশ থেকে ৫ কিলোমিটার দূরত্বের অবস্থিত গুটিয়া এলাকা। এখানেই ৩০০ ঘর তাঁতি আছেন বর্তমানে, যারা জামদানি ও বেনারসি বুনন করে জীবিকানির্বাহ করছেন। এক সময় এই এলাকায় ২ শতাধিক কারখানায় ১২ শ এর বেশি তাঁতকল ছিল, ব্যবসাও ছিল রমরমা। আর এখন সেই সুতার দাম বৃদ্ধি এবং ভারতীয় শাড়ির আগ্রাসনে ধ্বস নেমেছে গুটিয়ার বেনারসি শিল্পেও। তাই এই অঞ্চলের প্রায় শতাধিক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে।
সপ্তাহে মাত্র ৩-৪ টি শাড়ি বুনে থাকেন তাঁতিরা, শাড়ি প্রতি ৭০০টাকার মত মুজুরি পান। এর স্বল্প আয়ে জীবনযাত্রা বেশ কঠিনই হয়ে যায় তাদের। তারপরও বংশ পরম্পরায় আজও অনেক তাঁতি গুটিয়ায় বেনারসি, কাতান আর জামদানি বুনে তাদের সুনাম ধরে রেখেছে।
রংপুরের বেনারসি পল্লিঃ
উত্তরের জেলা রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলায় মাঝারি মানের একটি বেনারসি পল্লি গড়ে উঠেছে। রংপুর শহর থেকে প্রায় ১৬ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত এই এলাকায় রয়েছে বেনারসি তৈরির কারখানা ও বিপণন ব্যবস্থা। ২০০৫ সালে প্রায় ১০০ তাঁতি এই বেনারসি পল্লি গড়ে তোলেন। এ উপজেলার তালুক হাবু গ্রামসহ আশেপাশের আরও কয়েকটি গ্রামে এ শিল্পের বিকাশ ঘটেছে। জানা যায়, এখানকার তাঁতশিল্পের যাত্রা শুরু হয়েছিল আবদুর রহমান নামের একজনের হাত ধরে। এরপর তার প্রতিবেশিরাও এই কাজে যোগ দিতে থাকে এবং আস্তে ধীরে দেখা যায় হাবু গ্রামের প্রায় সবাই এই তাঁত কাজের সাথে জড়িয়ে পরেছে।
২০১৯ সালের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এক সময় ৬০০ তাঁত ছিল এই বেনারসি পল্লিতে, চাহিদা অনুযায়ী উপযুক্ত বাজার ব্যবস্থা, শ্রমিক সংকট, স্থানীয় ভাবে সুতা না পাওয়া এবং প্রসেসিং ও কাটিং মেশিনের অভাবে যা কমে বর্তমানে ১০০ এর নীচে নেমে গেছে। তবে হাবু বেনারসি পল্লি সহ গঙ্গাচড়ার বিভিন্ন এলাকা মিলে ১৩২ জন তাঁত মালিকের প্রায় ৬০০ তাঁতে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার পুরুষ ও ৪০০ নারী কাজ করছেন। এ এলাকায় ৬৪টি পরিবারের মধ্যে সমন্বয় করে তাঁত স্থাপনের জন্য ৬৮০ বর্গফুট আয়তনের ৪০টি শেড নির্মান করা হয়েছে, যেখানে নিঁখুত বুননে তৈরি হচ্ছে বাহারি সব বেনারসি শাড়ি। প্রতি বছর এই বেনারসি পল্লি থেকে ১হাজার পিসের মত শাড়ি উৎপাদন করা হয়। দেশের চাহিদা মিটিয়ে এগুলো শাড়ি বিদেশেও রপ্তানি হয়।
এখানে বেনারসি, বারবুটা, কুচিকাট, ফুলকলি, ব্রোকেড কাতান, পিরামিড কাতান, মিরপুরি রেশম কাতান, বেনারসি কসমস, চুনরি কাতান, জুট কাতান, প্রিন্স কাতান ইত্যাদি শাড়িগুলো তৈরি হচ্ছে। বেনারসি কাতান বিক্রি হচ্ছে ১৮০০-৭০০০ টাকা পর্যন্ত, জুট কাতান বিক্রি হচ্ছে ৪০০০- ৭০০০ টাকা পর্যন্ত, আর বিয়ের গর্জিয়াস বেনারসিগুলো বিক্রি হচ্ছে ১৩০০০-২৩০০০ টাকা পর্যন্ত৷ শুধু শাড়িই না এখানে থ্রিপিস, টুপিস এবং পাঞ্জাবিও তৈরি হয়। জুট কাতানের থ্রিপিস ৩-৪ হাজার টাকায় এবং কাতানের থ্রিপিস ১৫০০-২২০০ টাকায় বিক্রি হয়৷ আর পাঞ্জাবিও বিক্রি হয় ১২০০- ২৫০০ টাকায়।
এই বেনারসি পল্লির প্রধান সমস্যা হচ্ছে, নিজস্ব প্রসেসিং ও কাটিং ব্যবস্থা নেই এবং আধুনিক ডাইয়িং মেশিনও নেই। বুননের পর প্রসেসিং এবং কাটিং এর জন্য পাঠাতে হয় মিরপুরের বেনারসি পল্লিতে, সেখান থেকে নারায়নগঞ্জে। তাই পুরো প্রক্রিয়ায় আরও বাড়তি ১৫দিন সময় বেশি লাগায় প্রায়ই ঠিক টাইমে অর্ডারের শাড়ি ডেলিভারি দেয়া সম্ভব হয় না।
আরও জানা যায়, শাড়ির সুতা তোলার কাজ করেন যেসব নারী শ্রমিক, তারা মাত্র ৩০-৪০টাকা মুজুরি পান। পুরো সপ্তাহে ২০টি শাড়ির বেশি সুতা তোলা সম্ভব হয় না। শোরুমগুলোতে ৭-৮ হাজার টাকায় বিক্রি হওয়া একটা শাড়ির কারিগররা মুজুরি পান দেড় থেকে দুই হাজার টাকা। সহজ বুননের একটা বেনারসি তৈরিতে প্রায় এক সপ্তাহ লেগে যায়, আর জটিল বুননের বেনারসি তৈরিতে ৩জন তাঁতির ৩মাস পর্যন্ত সময় লাগে।
বগুড়ার বেনারসি পল্লিঃ
বগুড়ায় বেনারসি পল্লির যাত্রা শুরু হয়েছে অনেক বছর আগে এবং এটি বেশ সমৃদ্ধিও লাভ করেছে। বগুড়া শহর থেকে প্রায় ২৮ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত শেরপুর উপজেলার শাহবন্দেগী ইউনিয়নের ঘোলাগাড়ি কলোনি গ্রামে অবস্থিত এই বেনারসি পল্লি। এই পল্লির মানুষগুলোর আদি নিবাস ছিল ভারতের বিহার রাজ্যে, তাই স্থানীয়রা তাদেরকে বিহারি বলেই জানে। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর ভারতের বিহার রাজ্য থেকে এসেছিল এই অঞ্চলে বেনারসির গোড়াপত্তনকারী আব্দুল ওয়াহেদের পূর্ব পুরুষরা৷
ঘোলাগাড়ি কলোনির আরেকটি এলাকার নাম নদীয়াপাড়া। নদীয়াপাড়া নামের কারণ এই অঞ্চলের বাসিন্দারা ভারতের নদীয়া থেকে এসে এখানে বসত গড়েছিলেন। এখানেই ১৯৯৫ সালে প্রথম আব্দুল ওয়াহেদ নামের ব্যাক্তি ১৫ বছর ধরে মিরপুরের তাঁতে কাজ করার পর এসে এ এলাকায় বেনারসি উৎপাদন শুরু করেন৷ ধীরে ধীরে এখানে ৭৫টি তাঁত বসানো হয়েছিল, যা কমে এখন আছে মাত্র ২৫টি তাঁত। এক সময় এই দুই পাড়ার ৭০টি পরিবার বেনারসি তৈরি করলেও এখন অনেকেই তাঁতি পেশা ছেড়ে দিয়েছেন, হাতে গোনা ১০-১২জন তাঁতি এখন বেনারসি তৈরির কাজ করে যাচ্ছেন।
প্রথমদিকে এখানের তাঁতে বেনারসি, পিউর জংলা সাটিন, জামদানি, ধুপিয়ান আর কাতান সহ বিভিন্ন ডিজাইনের এক্সক্লুসিভ শাড়ি তৈরি হত। আর বর্তমানে কম দামের শাড়িগুলোই এখানে বেশি তৈরি করা হচ্ছে বাজার চাহিদার কথা মাথায় রেখে। তবে বিয়ের শাড়ি হিসেবে যে জংলা সাটিন বেনারসি তৈরি করা এখনো, এর বাজার মূল্য ৩৭-৪০হাজার টাকা এবং এটি তৈরি করতে ২২দিন সময় লাগে।
পাবনার বেনারসি পল্লিঃ
উন্নতমানের বেনারসি শাড়ি তৈরি এবং বাজারজাতকরণে অন্যতম পাবনার ঈশ্বরদি। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বেনারসি পল্লিও বলা হয় একে।
ঈশ্বরদি শহর থেকে অর্ধকিলোমিটার দূরত্বে ফতেমুহম্মদপুরে গড়ে উঠেছে এই বেনারসি পল্লি। এখানে প্রায় প্রতি ঘরেই তাঁতিরা ব্যস্ত বেনারসি কাতান তৈরিতে। এই বেনারসি পল্লিতে চার শতাধিক কারখানায় অন্তত চার হাজার লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। এই তাঁতে যে বেনারসি কড়িয়াল কাতান তৈরি করা হয়, এর পাইকারি দামই হয় ১৪ হাজার টাকা। এছাড়া জামদানি বেনারসি বিক্রি হচ্ছে ৬ হাজার ৫০০ টাকা। ঈশ্বরদির বেনারসি পল্লিতে তৈরি হয় লেহেঙ্গাও, একে বলা হয় থ্রি-পার্ট লেহেঙ্গা।
এছাড়া আকর্ষনীয় ডিজাইনের আনারকলি ও থ্রিপিসও তৈরি করছেন এখানের তাঁতিরা। কোন উৎসবের মৌসুমে ব্যস্ততা বেড়ে যায় তাঁতিদের, কয়েক শতাধিক কারখানার কয়েক হাজার কারিগর চরম ব্যস্ততায় শাড়ি বুনে চলেন। তখন সপ্তাহে দুই হাজার পিস শাড়িও তৈরি হয় এই তাঁতগুলোতে, যা ঢাকা এবং অন্যান্য জায়গার বড় বড় শোরুমগুলোতে সাড়ে ৩ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকায় বিক্রি হয়, কখনো কখনো জমকালো বেনারসিগুলো ২০-৫০ হাজার টাকায়ও বিক্রি হয় শোরুমগুলোতে।
একেকজন তাঁতি দৈনিক ১২/১৪ ঘন্টা কাজ করে সপ্তাহে দুইটি মাত্র শাড়ি তৈরি করতে পারে। তাঁতিদের তৈরি এসব রং বেরং এর কাতান, বেনারসি ও জর্জেট শাড়িগুলোর কিছু ডিজাইন পাইকারিতে সাড়ে ৫হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা দোকানে খুচরা বিক্রি হয় ৮-১০ হাজার টাকায়। ২০১৯ সালের এক প্রতিবেদনে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, ঈদের আগে ঈশ্বরদির এই বেনারসি পল্লি থেকে ২০ কোটি টাকার শাড়ি পাইকারিতে বিক্রি হবে বলে আশাবাদি ছিলেন এখানকার ব্যবসায়ীরা। তার মানে বেশ জমজমাট এই বেনারসি পল্লি এতে কোন সন্দেহ নেই।
দরিদ্র তাঁতিদের অবস্থার পরিবর্তন করতে সরকার ২০০৪ সালে ঈশ্বরদির ফতেমোহাম্মদপুর এলাকায় বেনারসি পল্লি স্থাপন করেছিল। দেশব্যাপী এখানকার বেনারসির সুনাম ছড়িয়ে যাওয়ার পাশাপাশি ভারতেও পাবনার বেনারসি অনেক জনপ্রিয়তা পেয়েছে এবং অন্যান্য দেশেও রপ্তানির সুযোগ রয়েছে।
ঢাকার রাজবাড়ীর বেনারসি পল্লিঃ
২০১৪ সালের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ছোট পরিসরে হলে ঢাকার রাজবাড়িতে গড়ে উঠেছে বেনারসি পল্লি। রাজবাড়ির বালিয়াকান্দি উপজেলার বাড়াদী গ্রামে এই ছোট বেনারসি পাড়া গড়ে উঠেছে লিটন মল্লিক নামের একজনের উদ্যোগে। লিটন মল্লিক বেনারসি তৈরির প্রশিক্ষন নিয়েছিলেন মিরপুরের বেনারসি পল্লিতে। তারপর নিজ গ্রামে ফিরে এসে ২০০৬ সালে শুরু করেন বেনারসি তৈরির কাজ। নিজের একটি বাইসাইকেল মাত্র ২৫০০ টাকায় বিক্রি করে সেই টাকায় মিরপুর থেকে কিনে এনেছিলেন বেনারসির প্রথম কাঁচামাল এবং শুরু করেছিলেন এই উদ্যোগ। আস্তে ধীরে কাজের পরিধি বাড়ায় গ্রামের লোকদের বিশেষ করে বেকার যুবক এবং নারীদেরকে প্রশিক্ষন দিয়ে তার কাজের সাথে যুক্ত করেন৷ তার প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত কর্মীদের দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে বেনারসি তাঁত তৈরি করেছেন বালিয়াকান্দির বিভিন্ন গ্রামে।
এই তাঁতগুলোতে জর্জেট, ধুপিয়ান, নেট সিল্ক ও টিস্যু বেনারসি তৈরি করা হয়। একেকটা শাড়ি তৈরিতে ৭-১০ দিন সময় লাগে তাদের। বিয়ে এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য এখানে ৫-৩০ হাজার টাকার মাঝে শাড়ি তৈরি করেন তারা এবং এই শাড়িগুলো ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন জেলায় যায়।
ঋন সহায়তা এবং পৃষ্ঠপোষকতা এই অঞ্চলের বেনারসি শিল্পকে বেগবান করবে বলে আশা করেন উদ্যোক্তা লিটন মল্লিক।
নারায়নগঞ্জের বেনারসি পল্লিঃ
শীতলক্ষ্যা তীরবর্তী নারায়নগঞ্জ জেলাকে ঐতিহ্যবাহী জামদানির আঁতুড় ঘর বলে জানলেও এই জেলায় রয়েছে বেনারসি তৈরির সুদক্ষ তাঁতি এবং কারিগররা, যারা সারাদেশেই বেশ সুনাম কুড়িয়েছেন তাদের দক্ষ বুননশৈলি দিয়ে। নারায়নগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার দুটি গ্রাম হলো – ফতেপুর ইউনিয়নের লতব্দী ও হাইজাদী ইউনিয়নের নারান্দী। এই গ্রাম দুটিকে একত্রে ‘আড়াইহাজারের বেনারসি পল্লি’ বলে ডাকা হয় শত বছর ধরে। এখানের তৈরি বেনারসি, কাতান শাড়িগুলো বিক্রি হয় ঢাকার মিরপুরের বেনারসি পল্লিতে ও সারাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের শোরুমগুলোতে, এমনকি দেশের বাইরেও এগুলো রপ্তানি হয়ে থাকে।
২০১৯ সালের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, সব মিলিয়ে লতব্দী গ্রামে বেনারসি কারখানা আছে ৫০-৬০টি এবং নারান্দীতে আছে ১০-১৫টি। দুই গ্রামের প্রায় ৭০-৭৫টি কারখানায় ২০-২৫টি করে তাঁতকল আছে এবং প্রতি কলে দুজন করে কারিগর কাজ করে থাকে। একজন মূল কারিগর শাড়ি বুনেন, অপরজন চড়কায় সুতা কাটেন। সুতা কাটার কাজটা মূলত নারীরাই করে থাকে, আর বুনন কাজ করেন পুরুষরা। তৈরির পর প্রতিটি শাড়ির বিক্রি থেকে ৫-৬ শত টাকা লাভ আসে তাদের৷
সিরাজগঞ্জের বেনারসি পল্লিঃ
বাংলাদেশের অন্যতম তাঁতশিল্প প্রধান অঞ্চল বলে পরিচিত সিরাজগঞ্জ জেলা। এই জেলার বিভিন্ন তাঁত পল্লীতে তৈরি হয় গুনগত মানসম্পন্ন ও আকর্ষনীয় সব ডিজাইনের জামদানি, সুতি জামদানি, সুতি কাতান, বেনারসি ও বিভিন্ন ধরনের লুঙ্গি, যা দেশের চাহিদা মিটিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশসহ রপ্তানি হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। এ জেলার বেলকুচি, শাহজাদপুর ও এনায়েতপুরে খুকনি এলাকার তৈরি বেনারসি সারাদেশে অনেক বেশি জনপ্রিয় বলে জানা যায়। তবে সিরাজগঞ্জের বেনারসি শিল্প, এর ইতিহাস এবং অবস্থা নিয়ে ইন্টারনেটে পর্যাপ্ত তথ্যের অভাব রয়েছে।
বেনারসির প্রধান কাঁচামাল সিল্ক বা রেশম সুতার ঘাটতি দূরীকরণ ও এর সমৃদ্ধিতে করণীয়ঃ
সিল্ক নিয়ে বাংলাদেশের সব কিছু মূলত রাজশাহী অঞ্চল কেন্দ্রিক ছিল এবং এখনো তাই আছে। এর কারন হল ঐ অঞ্চলে রেশম উৎপাদনের আদর্শ অবস্থা বিদ্যমান। এটি ভাল দিক কিন্তু আবার এটিই সমস্যা। সিল্কের সাথে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা বা বন্দরনগরি চট্টগ্রাম অথবা অন্য বড় বিভাগীয় শহর গুলোর কোন রকম সম্পর্ক নেই। রেশম নিয়ে সবার আগে এই অবস্থা বদলাতে হবে। অন্তত বিভাগীয় শহরের উদ্যোক্তাদের এদিকে সম্পৃক্ত করতে হবে। আর এটা করতে পারে এক মাত্র ইন্টারনেট আরো বিশেষ ভাবে বলতে হয় ফেইসবুক।
সিল্ক নিয়ে বেশীরভাগ মানুষ তেমন জানি না। অনেকের ধারনা এটি খুব দামি মানে সিল্কের শাড়ির দাম অনেক। সপুরা সিল্ক একটি বিখ্যাত কোম্পানি এবং তাদের ঢাকায় দোকান আছে। সিল্ক দিয়ে যে শাল হয় তা আমাদের প্রায় সবার অজানা ছিল। ২০২১ সালের শীতকালে এ নিয়ে ফেইসবুকে দেশি পণ্যের বিভিন্ন গ্রুপে কিছু পোস্ট আসে। সিল্কের শার্টও হয়। কিন্তু আমরা সিল্ক নিয়ে শাড়ির বাইরে তেমন কিছু জানি না। বেনারসি সিল্কের শাড়ি বিয়েতে কনেরা পরে আরো অন্তত ৬০ বছর আগে থেকে। সিল্ক নিয়ে প্রচারের আগে দরকার আসলে মান সম্মত কন্টেন্ট তৈরি করা।
সিল্ক নিয়ে বাংলাতে আলাদা কোন ওয়েবসাইট নেই। আবার Bangladeshi Silk নিয়েও ইংরেজিতে আলাদা কোন ওয়েবসাইট নেই। তথ্যের অভাব এজন্যই এতটা। তাই আমরা অনেকেই জানি না যে ব্র্যাকের অধীনস্থ আড়ং মানিকগঞ্জে রেশম চাষ করছে। তার মানে মানিকগঞ্জের মাটি ও জলবায়ু রেশম চাষের উপযোগী। এভাবে মানিকগঞ্জের আশে পাশের জেলা গুলোতে এ নিয়ে সরকারি ভাবে পরীক্ষা চালানো উচিৎ। সিল্কের চাহিদা বিশ্বব্যাপী এবং রেশম চাষ করে কোন লস বা লোকসান নেই। এই ধরনের আইডিয়া নিয়ে কাজ করার জন্য আলাদা ওয়েবসাইট, ফেইসবুক গ্রুপ, ইউটিউব চ্যানেল থাকা দরকার।
সিল্ক উৎপাদন কি লাভজনক?
এমন প্রশ্ন অনেকের মাথায় আসা স্বাভাবিক। ব্র্যাকের মতে বাংলাদেশে সিল্কের যে বাৎসরিক চাহিদা (৩৬০ মেট্রিক টন) তার মাত্র ছয় ভাগের এক ভাগ (৬০ মেট্রিক টন) উৎপাদিত হয়। তার মানে সিল্কের উৎপাদন দ্বিগুণ বা তিন গুণ হলেও তার বাজার এদেশেই রয়েছে। দেশের মানুষের মাথা পিছু আয় যে হারে বাড়ছে তাতে করে আগামী ১০ বছরে সিল্কের পোশাকের ব্যবহার বাড়বে সন্দেহ নেই। তাই সিল্কের চাহিদা আরো অনেক বাড়বে আগামী বছর গুলোতে এটি সহজেই বুঝা যাচ্ছে।
সিল্কের আরেকটি বিশেষ দিক হল এটি শ্রম ঘন ইন্ডাস্ট্রি। সিল্ক উৎপাদন করতে অনেক কৃষক লাগে এবং এরপর তা থেকে সুতা তৈরি করে পোশাক তৈরি করতেও অনেক শ্রমিকের দরকার। আর তাছাড়া সিল্ক সব সময় ধনীদের পোশাক বলে বিবেচিত সারা বিশ্বে। তাই এর মূল্য পাওয়া কঠিন না। ইংরেজি দৈনিক নিউ এইজ পত্রিকার এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে Md Liakat Ali, president of Bangladesh Resham Shilpa Malik Samiti, বলেন যে দেশে সিল্ক সুতার চাহিদা ৪০০ টনের মত কিন্তু উৎপাদিত হয় মাত্র ৪০ টন বা ১০% এবং সেই সুতার মান খুব ভাল না। ফলে বিদেশি সিল্ক সুতার উপর নির্ভরশিল।
২০১৮ সালে সারা বিশ্বে সিল্কের উৎপাদন ছিল ১ লাখ ৬০ হাজার মেট্রিক টনের মত আর বাংলাদেশের উৎপাদন ছিল মাত্র ৪৪ মেট্রিক টন। ২০০৫ সালের জাতীয় রেশম পলিসির অন্যতম লক্ষ্য ছিল ২০১৫ সালের মধ্যে উৎপাদন ৪৪৪ মেট্রিক টনে উন্নীত করা। কিন্তু তার ১০%ও অর্জিত হয় নি। ফলে চাহিদা বেড়েই চলেছে কিন্তু সেই তুলনায় উতপাদনে বিশাল ঘাটতি রয়েছে। এই ঘাটতি দূর করার জন্য জরুরী ভিত্তিতে সরকারি পদক্ষেপ নেয়া দরকার। তা না হলে আমদানি বেড়েই চলবে এবং এক সময় অনেক বৈদেশিক মুদ্রা খরচ হবে এ খাতে আমদানি করার জন্য।
সিল্কের সারা বিশ্বব্যাপী বাজার রয়েছে। তা সেটা সুতা হোক বা কাপড়। তাই এদিকে উৎপাদন বাড়াতে পারলে তার ক্রেতা দেশে বিদেশে সব জায়গাতেই রয়েছে। যা দরকার তাহল সারা দেশের সব জেলাতেই এ নিয়ে আগ্রহ তৈরি করা। সব জেলাতে হয়তো রেশম উৎপাদন করা সম্ভব হবে না কিন্তু যত বেশি জেলাতে এটি করা যাবে তার সুফল অনেক বছর ধরে সেই জেলা গুলো পাবে। নতুন নতুন কর্মসংস্থান হবে।
এজন্য দরকার সিল্ক নিয়ে গবেষণা। দরকার হল চীন সরকারের সাহায্য নিয়ে এদিকে বিশেষজ্ঞ এনে গবেষণা করা যেতে পারে। উল্লেখ্য চীন বিশ্বের সবচেয়ে বড় সিল্ক উৎপাদন কারি দেশ।
সিল্ক উৎপাদন নিয়ে গবেষণার জন্য বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে এ নিয়ে ই্সটিটিউট চালু করা যেতে পারে। শুধু রেশম চাষ বা উৎপাদন নিয়েই নয় বরং কিভাবে আরো ভাল করে মার্কেটিং বা বাজারজাত করন করা যায়, কিভাবে মানসম্মত কন্টেন্ট তৈরি করা যায় বা কিভাবে এর প্রচার বাড়ানো যায় এদিকে চিন্তা করতে হবে।
মোট কথা সিল্কের জন্য যত দিকে আমরা চেষ্টা করতে পারবো তা সুফল নিয়ে আসবে সব দিকেই। একদিকে কর্মসংস্থান বাড়বে, অন্যদিকে আমদানি ব্যয় কমবে এবং রপ্তানির সম্ভাবনাও তৈরি হবে। আর এজন্য দরকার ই-কমার্সের সুফল সিল্কের দিকে নিয়ে আসার।
ফেইসবুকে এখন দেশে ৫ কোটির মত একাউন্ট রয়েছে। দেশি পণ্য নিয়ে অন্তত ৫০০ এর মত গ্রুপ আছে এবং ফেইসবুকের মাধ্যমে ২০২০ সাল থেকে দেশি পণ্য প্রচার ও প্রসারের উদ্যোগ ব্যপক হারে বেড়েছে। এসব গ্রুপের মাধ্যমে সিল্ক নিয়ে অনেক তথ্য আসা নিশ্চিত করা যেতে পারে। সব ধরনের সিল্ক পণ্য নিয়ে একটি ওয়েবসাইট তৈরি করা গেলে খুব ভাল হত। এতে করে যে কেউ বাংলাদেশী সিল্কের পণ্য নিয়ে সব তথ্য এক জায়গাতে পেত। এতে করে বিদেশে সিল্কের তৈরী পোশাক বিক্রি করতেও সহজ হবে। প্রবাসি অনেক বাংলাদেশী চান দেশের পোশাক কিনতে।
তবে তার থেকেও অনেক বেশি সুফল বয়ে আনবে যদি ফেইসবুকে এ নিয়ে প্রচার চালানো যায়। এক সাথে ১০০ গ্রুপে সিল্ক নিয়ে প্রচার চালানো গেলে তা সহজেই অন্তত ১০ লাখ লোকের কাছে পৌছে যাবে। এজন্য আসলে তেমন কোন খরচের ব্যপার নেই। প্রথমে ২০-৩০ টি গ্রুপের এডমিনরা এক সাথে বসে কোন অফলাইন ইভেন্টে বা আড্ডায় একমত হলেই হবে। গ্রুপ গুলো দেশি সিল্কের ওয়েভের মত কিছু করতে পারে। তাতে করে সিল্কের প্রচার অনেক বাড়বে এক মাসের মধ্যে।
আমাদের সিল্ক ইন্ডাস্ট্রির সবচেয়ে বড় সমস্যা হল এর প্রচার না থাকা। যারা ফ্যাক্টরি মালিক তাদের এদিকে তেমন কোন কার্যক্রম নেই। অবশ্য তাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই কারন নানা ধরনের সমস্যার মধ্যে জর্জরিত তারা।
তাই দেশি পণ্য নিয়ে ই-কমার্স উদ্যোক্তাদের এদিকে এগিয়ে আসতে হবে নিজেদের স্বার্থে। ১০০ গ্রুপ মিলে সহজেই এ কাজটি করতে পারে।
শেষকথাঃ
বেনারসির আদি নিবাস বাংলাদেশে না হলেও, এটি এর পূর্বপুরুষ, তাঁতি বা কারিগরদের হাত ধরে বাংলায় এসে এর সাথে খুব শক্ত বাঁধনেই জড়িয়ে গেছে এবং এদেশের মাটি ও মানুষের সাথে মিশে গেছে। যুগ যুগ ধরে গুনে মানে সেরা জায়গায় দখল করে রেখেছে এদেশে তৈরি বেনারসি শাড়ি। তাই বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই এর চাহিদা রয়েছে ব্যাপক। ভারত বেনারসির আদিনিবাস হলেও বাংলাদেশ থেকে প্রচুর বেনারসি সেদেশে রপ্তানি হয় এবং ভারতীয় নারীদের মাঝে বেশ জনপ্রিয় এগুলো। এছাড়াও পাকিস্তানেও আমাদের দেশের বেনারসি রপ্তানি হয় অনেক বেশি।
বর্তমানে বেনারসি বলতে শুধু শাড়িই বোঝায় না, বরং আধুনিক ফ্যাশন স্টাইলের সাথে খাপ খাওয়াতে অনেক ইনোভেশন এতে এসেছে এবং আসার আরও সুযোগও রয়েছে। বেনারসি, কাতান ফেব্রিক দিয়ে এখন থ্রিপিস, পাঞ্জাবি, কটি, লেহেঙ্গা, গাউন ইত্যাদি পোশাক তৈরি হওয়ার পাশাপাশি ব্যাগ, পার্স, শাল, ইত্যাদিও তৈরি হচ্ছে। এছাড়াও এই অলংকৃত জটিল নকশার বেনারসি দিয়ে অনেক ইনোভেশন আসতে পারে, যা দেশের বাইরেও রপ্তানিযোগ্য পন্যের নতুন ক্ষেত্র তৈরি করবে।
আমাদের সবচেয়ে গুরুত্ব দিতে হবে আসলে আমাদের তাঁতিদের নিঁখুত এই কাজকে আরও ভালো ভাবে তুলে ধরার দিকে। অঞ্চলভিত্তিক বেনারসি শিল্প ও পল্লি নিয়ে অনেক তথ্যের ঘাটতি রয়েছে, প্রমোশনের অভাব রয়েছে এবং ক্যাটাগরি ও ডিজাইন অনুযায়ী বেনারসিগুলোর পরিচিতিমূলক তথ্য জানার সোর্সের অভাব রয়েছে। তাই এদিকে আমাদেরকে আরও চেষ্টা করতে হবে এবং এই শিল্পের যথাযথ ব্র্যান্ডিং করতে হবে।
তবে যে বিষয়টি নিয়ে আমাদেরকে এখন ভাবতে হবে বিশেষ ভাবে, তা হল- বেনারসি ভারতের বেনারস প্রদেশের জিআই পন্য হিসেবে স্বীকৃত। তাই এই নাম ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমাদের বাঁধা রয়েছে। ডিজাইন অনুযায়ী আমাদের দেশে বিভিন্ন নামেই কিন্তু এই বেনারসি শাড়িগুলো পরিচিতি লাভ করে, সেই নামগুলোতেই আমরা একে চিনতে পারি, জানতে পারি এবং প্রচার করতে পারি।
লেখিকাঃ
Very nice writing Amrita Rani Deb. I enjoyed reading it
ধন্যবাদ আপু সব তথ্য এত ডিটেইলস ভাবে লেখার জন্য।বেনারসি শাড়ির পঞ্চকার্ড ব্যাবহার করে ডিজাইন করার বিষয়টি খুবই ট্যালেন্টেট কাজ।সেদিন একটি ভিডিও কন্টেন্ট দেখেছিলাম।ডিজাইন তৈরী করা থেকে শুরু করে প্রতিটি ধাপ খুব যত্নের সাথে করে।
বেনারসি নিয়ে তথ্য সম্বলিত পোস্টের জন্য ধন্যবাদ ডেয়ার
বেনারসির ইতিহাস থেকে শুরু করে এর অদ্যোপান্ত জানতে পারলাম আপনার লেখনীতে। আমাদের বিভিন্ন জেলায় বেনারসি পল্লি থাকলেও প্রচারনা এবং জানার আগ্রহ কম থাকার কারনে পিছিয়ে রয়েছে আমাদের এই পণ্যটি।
আপনার শেষ কথাটি খুব ভালো লেগেছে আপু, বেনারসি নাম ব্যবহার না করে আমরা ডিজাইন ভেদে যে নাম সেগুলো ব্যবহার করতে পারি। এজন্য অবশ্যই মাঠ পর্যায় থেকে এই শাড়ি সম্পর্কে জানতে হবে কারন একেক দোকানি বা মহাজন একই শাড়ির হরেক রকম নাম দিয়ে থাকে। বেনারসি নিয়ে প্রচার ও কাজ করার সময় মিরপুর বেনারসি পল্লি ভিজিট করার সময় এই জটিলতা দেখেছিলাম।
অসংখ্য ধন্যবাদ আপু, এতো সুন্দর তথ্য বহুল কন্টেন্ট শেয়ার করার জন্য।