সিলেটের মনিপুরী শাড়ি

বাংলাদেশের প্রাচীন হস্তশিল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মনিপুরি তাঁতশিল্প। সিলেটের ঐতিহ্যের প্রতীক মনিপুরী শাড়ি তাঁতবস্ত্র হিসেবে দেশব্যাপী প্রসিদ্ধ। মূলত মনিপুরি সম্প্রদায়ের মেয়েদের ব্যবহৃত ‘মৈরাংগ ফী’ নামক বিশেষ ধরনের ওড়না থেকে উৎপত্তি মনিপুরি শাড়ির। ঐতিহ্যবাহী একরঙা মনিপুরী শাড়িতে থাকে ‘টেম্পল মোটিফ’র নকশা। পাশাপাশি শাড়ীর পাড়ের সাথে মিল রেখে জমিনে ও আঁচলেও বিভিন্ন নকশার সমন্বয় লক্ষ্য করা যায়। সম্পূর্ণ হস্তচালিত তাঁতে বোনা এই শাড়িতে গাঢ় বা হালকা যে কোন রঙের জমিনে ফুটে উঠে গাড় রঙয়ের মোটা পাড়- এমন স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের কারনেই আরামদায়ক সিলেটের মনিপুরি শাড়ি অনায়াসে বাঙালী নারীর মন জয় করে নিয়েছে।

মূলত সিলেট বিভাগে বসবাসরত দেশের অন্যতম নৃ-গোষ্ঠী মণিপুরী সম্প্রদায়। তাদের আদি নিবাস ভারতের মণিপুর রাজ্যে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত সংঘটিত বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ঘটনার প্রেক্ষাপটে বিশেষ করে বার্মা-মণিপুর যুদ্ধের সময় (১৮১৯-১৮২৫) মণিপুরের রাজা চৌরজিৎ সিংহ ও তার দুই ভাই মারজিৎ সিংহ ও গম্ভীর সিংহসহ অনেকে দেশ ত্যাগ করে সিলেটে আশ্রয় গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তাদের অনেকে মণিপুর ফিরে গেলেও অধিকাংশ মনিপুরীই স্থায়ীভাবে সিলেটে থেকে যায়।

সম্ভবত আঠারোশ শতক থেকে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করে মনিপুরী সম্প্রদায়ের অধিবাসীরা। তবে ভারতের মণিপুর থেকে আগত মণিপুরীরা সিলেটের পাশাপাশি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা ও ময়মনসিংহের দুর্গাপুর অঞ্চলেও বসতি স্থাপন করে। বর্তমানে ঢাকার মণিপুরীপাড়াতেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মনিপুরী সম্প্রদায়ের লোক বসবাস করছেন। তবে সবচেয়ে বেশি মনিপুরী জনগোষ্ঠীর বাস বর্তমান সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার, সিলেট সদর, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ জেলাগুলোতে।

সমৃদ্ধ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অধিকারী মনিপুরীদের তাঁত বুননে বিশেষ সুখ্যাতি রয়েছে। তাঁতশিল্পে মনিপুরী নারীদের দক্ষতার কল্যাণে তাদের প্রতিটি ঘর যেন এক একটি তাঁতের কারখানায় পরিণত হয়েছে। সিলেটের শ্রীমঙ্গল উপজেলার রামনগর মনিপুরী পাড়া, টিকরিয়া মনিপুরী পাড়া, কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর, আদমপুর, তেতই গাঁও, ঘোড়ামারা ও তিলকপুরসহ প্রায় ৬০টি গ্রাম মণিপুরী তাঁতশিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই তাঁত রয়েছে এবং মূলত উত্তরাধিকার সূত্রেই তারা তাঁত শিল্পের সাথে জড়িত। এখানকার প্রায় ৯০ শতাংশ নারী ঘরের কাজের পাশাপাশি তাঁত বোনার কাজে জড়িত এবং পুরুষরা তাঁত পণ্য বিপনন ও কাঁচামাল সংগ্রহের কাজ করে থাকেন।

মনিপুরি ভাষায় তাঁতকে ‘ইয়োং’ নামে অভিহিত করা হয়। মূলত তিন ধরনের তাঁত হয়ে থাকেঃ (১) কোমরে বাঁধা তাঁত বা কোমর তাঁত, (২) হ্যান্ডলুম তাঁত ও (৩) থোয়াং। তবে অপেক্ষাকৃত মোটা সুতার কাপড় বুননে সাধারণত ‘মোয়াং’ তাঁত ব্যবহার করা হয়, অন্যদিকে ‘পাং’ তাঁতের ব্যবহার হয়ে থাকে চিকন সুতার কাপড় বোনার ক্ষেত্রে। একটি সাধারণ ডিজাইনের মনিপুরী শাড়ির কাঁচামাল সংগ্রহে খরচ হয় প্রায় এক হাজার টাকার বেশি, আবার ভালো মানের সুতা ব্যবহারে কাঁচামালের ব্যয় প্রায় তিন থেকে চারগুন বৃদ্ধি পায়। একটি ডিজাইনার মনিপুরি শাড়ি বুননে ২ জন তাঁতির প্রয়োজন হয়। প্রথমে সুতায় মাড় দিয়ে রোদে শুকিয়ে নিয়ে তাঁতে বাঁধা হয়। তারপর ২ জন তাঁতি তাঁতের দুই পাশে বসে বুনন কাজ শুরু করেন এবং চার থেকে পাঁচদিন সময় দিয়ে একটি শাড়ি তৈরি করেন। তাঁতে বাঁধা কাপড়ে নকশা তোলার জন্য তাঁতিরা এক ধরণের সূচালো যন্ত্র ব্যবহার করে থাকেন।

মনিপুরি শাড়ি তৈরির প্রধান কাঁচামাল সুতা সংগ্রহ করা হয় মূলত ত্রিপুরা রাজ্য থেকে। তবে বর্তমানে দেশীয় বাজার থেকেও সুতি সুতা সংগ্রহ করা হয়। মূলত সুতি ও টেট্রন এই দুই ধরনের সুতোয় এই শাড়ি বুনা হয়ে থাকে। তবে পিউর সুতি সুতা দিয়ে তৈরী মনিপুরী শাড়ীর দাম তুলনামূলক অনেক বেশি হয়ে থাকে। এই শাড়ি বুননের ক্ষেত্রে আবহাওয়ারও উল্লেখযোগ্য প্রভাব রয়েছে। উষ্ণ ও শীতের প্রবাহকে কেন্দ্র করে সুতার ব্যবহারে ভিন্নতা থাকে। সাধারন মনিপুরী শাড়ির ক্ষেত্রে পাড়ে আংশিক ভারি গাড় সুতার সমতল কাজ করা হয়, অন্যদিকে ডিজাইনার শাড়ির ক্ষেত্রে উজ্জ্বল রঙের ‘টেম্পল পাড়’ বা টেম্পল মোটিফের পাড় ব্যবহার করা হয়। পাশাপাশি কিছু কিছু মনিপুরী শাড়িতে তাঁতিরা কম সুতা ব্যবহার করে গাঁথুনি বেশ পাতলা রাখে, ফলে অনেকের কাছে এটি ‘মশারীর জাল’ বলে পরিচিত। মূলত শাড়ির মান ও ডিজাইন (নকশা)- এই দু’য়ের উপর ভিত্তি করেই মনিপুরী শাড়ির দাম নির্ধারিত হয়, ফলে মান ও ডিজাইন ভেদে শাড়ির দামেও তারতম্য দেখা যায়।

অতীতে মনিপুরী তাঁতিরা শাড়িতে কানাপ, খাম্মেন, চাতপা, সাতকাপা ফি এর মতো বিভিন্ন নকশার ভারি কাজ ফুটিয়ে তুলতো। তবে বর্তমানে এসব কাজ খুব একটা দেখা যায় না। এখনকার তাঁতিরা বাজারে বিক্রি ও দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য সহজ নকশার কাজই বেশি করে থাকেন। মনিপুরী শাড়িতে ব্যবহৃত নকশার সবচেয়ে জনপ্রিয় মোটিফ হচ্ছে ঝাউ গাছ, শেফালি ফুল ও মন্দিরের নকশা; আর এই নকশাগুলোকে মনিপুরী রাজকুমারি ‘মইরাং থইবি’ -এর নাম অনুসারে ‘মইরাং ফি’ নামে অভিহিত করা হয়। তবে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে বর্তমানে বিভিন্ন আধুনিক নকশার সমন্বয়েও কাপড় তৈরি করছে মনিপুরী তাঁতিরা, ফলে এর চাহিদাও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে মনিপুরী তাঁতে তৈরি মনিপুরী জামদানী শাড়ি বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে যা মনিপুরী শাড়ির জন্য সম্ভাবনার এক নতুন দুয়ার উন্মোচন করেছে।

মনিপুরি তাঁতে শাড়ি ছাড়াও থ্রি-পিস, বাহারী শাল, ওড়না, গামছা, মশারী, মাফলার, তোয়ালে, চাঁদরসহ মনিপুরী সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী পোশাক তৈরি হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, মনিপুরি সম্প্রদায় মূলত নিজেদের পোশাকের চাহিদা পূরণ করার লক্ষ্যেই তাঁত বুননের কাজ শুরু করে। নিজেদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক থেকে শুরু করে বিয়ে ও নিত্য প্রয়োজনীয় পোশাক ‘ফানেক’ এর চাহিদাও মনিপুরী জনগোষ্ঠী এই তাঁত থেকেই পূরণ করে থাকে। তবে শুরুর দিকে শুধুমাত্র নিজেদের জন্য কাপড় তৈরি করলেও পর্যায়ক্রমে এটি বাণিজ্যিক রূপ নিয়েছে। বিশেষ করে বাঙালি সমাজে নারীদের কাছে ১৩ হাত মনিপুরী শাড়ি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করলে পর্যায়ক্রমে মনিপুরী তাঁতে তৈরি অন্যান্য তাঁতবস্ত্রগুলোও সৌখিন ও নিত্য ব্যবহার্য পণ্য হিসেবে বাঙালিদের মাঝে বিশেষভাবে সমাদৃত হতে শুরু করে।

ফলে সিলেটের মনিপুরী তাঁতিদের নিপুন হাতে বোনা বাহারী রঙের তাঁতবস্ত্রের চাহিদা যেমন দিন দিন বৃদ্ধি পেয়েছে তেমনি এর সুখ্যাতি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। রঙ ও নকশায় বৈচিত্র্যের কারনে মনিপুরী তাঁতবস্ত্রের প্রতি পর্যটকদেরও বিশেষ ঝোঁক রয়েছে। তাছাড়া বছর জুড়েই বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক উৎসব উপলক্ষ্যে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মণিপুরি শাড়ির চাহিদা বৃদ্ধি পায়।

তবে দেশে ও বিদেশে ব্যাপক চাহিদা থাকা সত্ত্বেও মনিপুরী তাঁতশিল্পের পরিধি অতীতের তুলনায় সংকীর্ণ হয়েছে। অনেক তাঁতি পরিবার বিকল্প জীবিকা বেছে নিয়েছেন। তবে এখনও বেশির ভাগ মনিপুরী নারী উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত এই তাঁত বুননের কাজকে ধরে রেখেছেন। মনিপুরী সম্প্রদায়ে মেয়েরা একটু বড় হলেই মায়েরা তাদেরকে তাঁত বুননের কাজ শেখায় কারন মনিপুরী সমাজে মেয়েদের তাঁতবস্ত্র তৈরির দক্ষতাকে সামাজিকভাবে বিশেষ করে বিয়েতে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে দেখা হয় এবং প্রাধান্য দেয়া হয়। সার্বিকভাবে মনিপুরী সংস্কৃতি ও কৃষ্টির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচিত এই তাঁত বুননশিল্প।

সিলেটের মণিপুরি তাঁত ও হস্তশিল্পের বিকাশে মণিপুরি যুব সমিতি নামের একটি সংগঠন গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। তাদের গড়ে তোলা মণিপুরি তাঁতশিল্প ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ১৯৭৭ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত দেড় শতাধিক তাঁতিকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিষ্ঠানটি তাঁতিদের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি বিনা সুদে ঋণ প্রদানসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রদান করছে যাতে করে মনিপুরী তাঁত শিল্পের বিকাশ সার্বিকভাবে আরও ত্বরান্বিত হয়।

বর্তমানে সময়ে অনলাইন বিজনেস বা ই-কমার্সের কল্যাণে সিলেটের মনিপুরী তাঁতিদের তাঁতবস্ত্র বিপণনের বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা আগে চেয়ে অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে। তাঁতিদের অনেকেই এখন তাদের তাঁতপণ্য দেশব্যাপী সরাসরি ক্রেতার কাছে বিক্রি করতে পারছেন। বিপণনের এই সুবিধার ফলে তাঁতিদের এখন আর অন্য কারো উপর নির্ভর করে থাকতে হচ্ছে না এবং তারা তাদের পণ্যের সঠিক মূল্যও পাচ্ছেন। এক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সঠিক ও কার্যকরী পৃষ্ঠপোষকতা পেলে মনিপুরী তাঁতবস্ত্র দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও বাজারজাত করা সম্ভব হলে তাঁতিরা মনে করছেন।

লেখিকাঃ

Amrita Rani Deb

Write your comment

Scroll to Top