বিশ্বের সবচেয়ে মসৃণ ও সুক্ষতম কাপড় হিসেবে বিবেচনা করা হয় বাংলার ঐতিহ্যবাহী মসলিন শাড়িকে। যদিও বর্তমানে মসলিনের দেখা পাওয়া সম্ভব হয় কোন জাদুঘরে বা কোন খ্যাতিমান ব্যক্তির ব্যক্তিগত সংগ্রহশালাতে। কারন প্রায় দুইশত বছরের ঐতিহ্যের ধারক বিশ্বের সবচেয়ে দামী কাপড় হিসেবে খ্যাত মসলিন আঠারোশ শতকের শেষার্ধে এসে বাংলার মাটি থেকে হারিয়ে যায়। এক সময় বাংলার বহুল প্রচলিত প্রায় ২৮ প্রকার মসলিনের মধ্যে বর্তমানে শুধুমাত্র জামদানীই মসলিনের একমাত্র উত্তরাধিকার হিসেবে এখনও টিকে আছে এবং এর জনপ্রিয়তাও আকাশছোঁয়া। তবে দু’শ বছর পূর্বের মসলিন শাড়ি থেকে আজকের জামদানী শাড়ি অনেকটাই আলাদা। প্রাচীন বাংলার অপূর্ব এই সম্পদ আজ বহুলাংশে বিলুপ্তপ্রায় হলেও বাংলার তাঁতশিল্পের ইতিহাসে মসলিন এক সোনালী অধ্যায় হিসেবে চির অম্লান হয়ে আছে।
অত্যন্ত নরম ও হালকা বিশেষ ধরনের ফুটি কার্পাস তুলা থেকে প্রস্তুত হতো মসলিন তৈরির অতি চিকন সুতা, আর সে সুতো থেকে তাঁতিদের দক্ষ হাতে বয়নের মাধ্যমে তৈরি হতো অতি সূক্ষ্ম ও উজ্জ্বল মসলিন শাড়ি। সে যুগে ঢাকাই মসলিন হিসেবে বিশ্বব্যাপী সমাদৃত এই শাড়ির কদর ছিলো অনেকটা ধনরত্নের মতোই।
মূলত ঢাকার মেঘনা নদীর দুই কূলে পলি পরা জমিতে ব্যাপকভাবে দুর্লভ কার্পাসের চাষ করা হতো। এই কার্পাস তুলা চাষাবাদেও ছিলো অনেক নিয়মকানুন। পূর্ণবয়স্ক গাছ থেকে বছরে দু’বার তুলা পাওয়া যেত। তবে বসন্তকালের ফুটি কার্পাস তুলাকেই মসলিন শাড়ি তৈরিতে সর্বোৎকৃষ্ট বলে মনে করা হতো। মূলত মসলিন তাঁতিরা নিজেরদের জমিতেই সে সময়ের সবচেয়ে দামী ফুটি কার্পাস তুলার চাষ করতেন।
বর্তমান বাংলাদেশের সোনারগাঁও ও ঢাকার পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতেই মসলিনের উৎপাদন হতো সবচেয়ে বেশি। এছাড়াও ধামরাই, তিতবাড়ি এবং জঙ্গলবাড়িতেও মসলিন বয়ন করা হতো। ফুটি কার্পাস তুলা ছিলো অনেক হালকা, নরম ও খাটো ধরনের যা দিয়ে সাধারন মেশিনে ভালো সুতা পাওয়া সম্ভব ছিলো না। কিন্তু স্থানীয় তাঁতিদের ১৬ ধাপের দক্ষ বুনন প্রক্রিয়ায় এই সুতোই পরিনত হতো বিশ্বের সবচেয়ে দামী কাপড়ে।
মসলিন তৈরির প্রথম ধাপে মেঘনা নদী থেকে পাওয়া বোয়াল মাছের চোয়ালের কাটার চিরুনি দিয়ে আচড়ে তুলার মন্ডগুলো পরিস্কার করা হতো। তারপর চরকায় সুতো কেটে তা নরম হাতে বুনতে হতো অত্যন্ত আদ্র পরিবেশে। ফলে দেখা যেত অল্পবয়সী মহিলারা নৌকায় বসে ভোর বা সন্ধ্যার আদ্র আবহাওয়ায় দক্ষ হাতে ও ভীষণ ধৈর্যের সাথে সুতোর কাজ করতেন। কারন বয়স্করা অতি সূক্ষ্ম মসলিন সুতা খালি চোখে কাটতে পারতেন না। সাধারণত খুব ছোটবেলা থেকেই পারিবারিকভাবে তাঁতিদের সন্তানদের হাতেখড়ি হতো শাড়ি তৈরির প্রক্রিয়ায়, ফলে পরিণত বয়সে এসে তারা খুবই দক্ষ হয়ে উঠতেন।
এমনই ভিন্ন ভিন্ন ধাপে তৈরি হওয়া ঢাকাই মসলিন শাড়িগুলো মূলত সর্বনিম্ম ৩০০ থেকে সর্বোচ্চ ১২০০ কাউন্টের সুতোয় তৈরি হতো এবং ওজন করা হতো রতি হিসেবে। এক রতি ওজনের সুতার দৈর্ঘ্য হত প্রায় ১৫০ থেকে ১৬০ হাত। সুতার সূক্ষ্মতা অনেকাংশেই নির্ভর করতো সুতার দৈর্ঘ্য ও ওজনের উপর; লম্বায় অধিক আর কম ওজনের সুতা থেকেই সাধারণত অতি সূক্ষ্ম সুতা পাওয়া যেত। সাধারণভাবে এক টুকরো ভালো মানের মসলিন শাড়ি তৈরিতে একজন তাঁতি ও তার সহকারীর ছয় মাস পর্যন্ত সময় লেগে যেত। তবে ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী নকশা, ফুল বা অন্যান্য অনুষঙ্গ জুড়ে দিতে আরো বেশি সময়ের প্রয়োজন হতো।
মসলিন শাড়ির স্বচ্ছতা নিয়ে ইতিহাসে অনেক কাহিনীর উল্লেখ রয়েছে। কথিত আছে যে, স্বচ্ছ কাঁচের মতো দেখতে মসলিন এতোটাই সূক্ষ্ম হতো যে ৫০ মিটার দীর্ঘ একটি মসলিন কাপড়কে অনায়াসে একটি দিয়াশলাই বাক্সে ভরে রাখা যেত।
ইতিহাস থেকে জানা যায় যে তৎকালীন বাংলায় প্রায় ২৮ রকমের ভিন্ন ভিন্ন মসলিন শাড়ি বয়ন করা হতো। মূলত বুননশৈলী, সুক্ষতা ও নকশার ভিন্নতায় এদের মধ্যে পার্থক্য করা হত। যেমনঃ মলবুস খাস, সরকার-ই-আলা, ঝুনা, আব-ই-রওয়ান, খাসসা, শবনম, নয়ন সুখ, বদন খাস, সর-বন্ধ, ডোরিয়া, জামদানী ইত্যাদি। আগেই উল্লেখ করেছি, মসলিন কাপড়ের উত্তরাধিকারী হিসেবে শুধুমাত্র জামদানি শাড়িই এখনও টিকে আছে যা বাঙ্গালি নারীদের মাঝে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়।
মুঘল আমলে মসলিন ছিল আভিজাত্যের প্রতীক। সে সময় রাজপরিবারের সদস্যদের রাজকীয় পোশাক এবং উচ্চ পদাধিকারী বিত্তবানদের পোশাক হিসেবেই মূলত মসলিনের ব্যাপক প্রচলন ছিলো। রাজপরিবারে মেয়েদের শাড়ি ও ছেলেদের জামা হিসেবে মসলিন দারুন জনপ্রিয় ছিলো। সম্রাট ও তার পরিবারের জন্য বিশেষভাবে তৈরি মসলিনের নাম ছিল ‘মলবুল খাস’ এবং বাংলার সুবাদারদের জন্য তৈরি মসলিন ছিল ‘সরকার-ই-আলা’। সে সময় সম্রাট্রের অনুমতি ব্যতীত মসলিন রপ্তানিতে বিধিনিষেধ ছিল।
তবে কালের পরিক্রমায় ইউরোপের রাজপরিবারসহ ধনাঢ্য ব্যক্তিদের মাঝে মসলিন সমানভাবে জনপ্রিয় হতে শুরু করে এবং তখন থেকেই মসলিন কাপড় দিয়ে গাউন, শার্টসহ বিভিন্ন ধরনের পোশাক ব্যবহারের প্রচলনও শুরু হয়।
ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, মসলিন শব্দটি এসেছে ‘মসুল’ শব্দ থেকে। ইংরেজ লেখক এস. সি. বার্নেল ও হেনরি ইউলের প্রকাশিত অভিধান ‘হবসন জবসন’- এ উল্লেখ আছে যে ইরাকের এক বিখ্যাত ব্যবসাকেন্দ্র ছিলো ‘মসুল’, আর এই মসুলে তৈরি অতিসুক্ষ কাপড় ইংরেজদের কাছে বেশ পরিচিত ছিল। পরবর্তীকালে তৎকালীন ঢাকা ও ঢাকার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে অতিসুক্ষ কাপড়ের সন্ধান পেলে ইংরেজরা ‘মসুল’ এর সাথে মিলিয়ে বাংলার অতি সূক্ষ্ম কাপড়টির নামকরন করে ‘মসলিন’। যদিও বাংলায় ‘মসলিন’বলতে মূলত তৎকালীন ঢাকা ও তার পার্শ্ববর্তী কিছু এলাকায় উৎপাদিত অতি সূক্ষ্ম এক প্রকার কাপড়কেই বোঝানো হতো।
ধারনা করা হয় ঢাকার ইতিহাস থেকেও পুরনো বাংলার মসলিনের ইতিহাস। প্রাচীন গ্রীসে মসলিন শাড়িকে দেবীদের মূর্তিতে পরানোর উপযুক্ত কাপড় হিসেবে বিবেচিত করা হতো। প্রথম খিস্টাব্দের প্রথম শতকে রচিত ‘পেরিপ্লাস অব দ্য এরিথ্রিয়ান সি’নামক গ্রন্থে রোমান অভিজাত নারীদের পরিধেয় হিসেবেও মসলিনের জনপ্রিয়তার কথা উল্লেখ রয়েছে। এই গ্রন্থে সর্বোৎকৃষ্ট মসলিনকে গেনজেটিক বা গঙ্গাজলী বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
এছাড়াও খ্রিস্টীয় চতুর্দশ শতকে বাংলা পরিদর্শন করে মরক্কোর বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা তার লেখা ‘কিতাবুর রেহালা’ শীর্ষক গ্রন্থে ঢাকার পার্শ্ববর্তী সোনারগাঁয়ের সুতি বস্ত্রের ভূয়সী প্রশংসা করেন। এখানে উল্লেখ্য, সোনারগাঁর তাঁতিদের হাতে তৈরি জামদানী এখনও দেশে-বিদেশে ব্যাপকভাবে সমাদৃত।
ভারতবর্ষের মুঘল আমলকে মসলিন কাপড়ের স্বর্ণযুগ হিসেবে বিবেচন করা হয়। মুঘল রাজবংশে প্রজন্মান্তরে রাজপোশাক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে মসলিন। ঐতিহাসিক আবুল ফজল যিনি সম্রাট আকবরের সভায় বিশিষ্ট সভাসদ ছিলেন এবং মূল্যবান গ্রন্থ ‘আকবরনামা’ রচনা করেন তিনিও সোনারগাঁয়ে তৈরি বাংলার মসলিন কাপড়ের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।
তবে সপ্তদশ শতকে ঢাকা বাংলার রাজধানী হলে ইংরেজ বণিকরা বাংলায় আসতে শুরু করার ফলে অনেক ইংরেজ লেখকের বিবরণীতে মসলিন সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। সেখান থেকেই জানা যায় বাংলার ঐতিহ্যবাহী মসলিন শিল্পের হারিয়ে যাবার ইতিহাস। ১৮৫৭ সালে পলাশি যুদ্ধে পরাজয়ের পর বাংলার ক্ষমতা পুরোপুরি চলে আসে ইংরেজদের হাতে এবং একসময় তাদের নির্মম অত্যাচারের ফলে অস্তিত্বের সংকটে পরে মসলিন তাঁতিরা এবং নিতান্ত বাধ্য হয়েই তারা ধীরে ধীরে মসলিন উৎপাদন বন্ধ করে দেয়।
অনেকেই মনে করেন ব্রিটিশ শাসকের আরোপিত মাত্রাতিরিক্ত কর ও মসলিন তাঁতিদের বৃদ্ধাঙ্গুল কেটে নেওয়ার মতো নৃশংস অত্যাচারের কারনেই মসলিন শিল্প এক সময় পুরোপুরি হারিয়ে যায়। পক্ষান্তরে অনেকের ধারনা ব্রিটিশদের শোষণ-অত্যাচারে তাঁতিরা নিজেরাই মসলিন বয়নে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে, আর তাই এই কাজ ছেড়ে দেবার জন্য তাঁতিরা নিজেরাই নিজেদের বৃদ্ধাঙ্গুল কেটে ফেলেন যাতে করে শাসক জোর করেও তাদেরকে দিয়ে আর কাজ করাতে না পারে। এভাবেই এক সময় বাংলার বুক থেকে হারিয়ে যায় গর্বের মসলিন শিল্প।
বাংলাদেশের একদল গবেষকের নেতৃত্বে ‘বাংলাদেশের সোনালি ঐতিহ্য মসলিন সুতা তৈরির প্রযুক্তি ও মসলিন কাপড় পুনরুদ্ধার (প্রথম পর্যায়)’ প্রকল্পের আওতায় ছয় বছর গবেষণার পর ২০২০ সালে ছয়টি ঢাকাই মসলিন শাড়ি তৈরি করা হয়। মসলিন এই শাড়িগুলো তৈরিতে হাতে কাটা ৫০০ কাউন্টের সুতো ব্যবহৃত হয়েছে এবং বয়ন করাও হয়েছে হাতে চালিত তাঁতেই। আগামীতে বাণিজ্যিকভাবে এই মসলিন শাড়ি সর্বসাধারণের জন্য বাজারে আনা সম্ভব হবে বলে গবেষক দল ও বিশেষজ্ঞরা আশা করছেন। এখানে উল্লেখ্য, ২০২০ সালের ২৮ ডিসেম্বর ঢাকাই মসলিনকে জিআই (ভৌগোলিক নির্দেশক) স্বত্বের অনুমোদনও দেয়া হয় যা এই শিল্পের অগ্রগতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে বলে শিল্পসংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
লেখিকাঃ