টাঙ্গাইলের শাড়ি

শাড়ি বাঙ্গালী নারীদের জীবনের সাথে মিশে আছে। শাড়িতে নারীকে লাগে অপরূপা, শাড়িতে নারীর সৌন্দর্য ফুটে উঠে যেভাবে তা অন্য কোন পোশাকে সম্ভব হয়ে উঠেনা, শাড়ি মানেই বাঙ্গালী নারীর আবেগ ভালোবাসা, দুঃখ সুখের স্মৃতিমাখা একটি পোশাক। আর এই শাড়ির নাম আসলেই টাঙ্গাইল জেলার কথা চলেই আসে কেননা টাঙ্গাইল এর শাড়ি গুণে মানে অনন্য, টাঙ্গাইল শাড়ির আছে নানান বৈচিত্র‍্য এবং বিভিন্ন রকমফের এবং টাঙ্গাইলের শাড়ি সকলের সাধ্যের মধ্যে সাধ পূরণ করে থাকে।

ঠিক কবে থেকে শাড়ির সূচনা তা স্পষ্টভাবে কোথাও ব্যাখ্যা নেই, তবে  চন্দ্রকেতুগড় থেকে পাওয়া পোড়ামাটির ফলকে প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক যে নিদর্শন মেলে সে ফলকে খ্রীস্টপূর্ব দ্বিতীয় থে প্রথম শতকেও শাড়ির দেখা মিলেছে। পাহাড়পুর এর পোড়ামাটির ফলকেও অষ্টম শতকেও নিদর্শন মেলে শাড়ির। শাড়ি পরার ধরণ ভিন্ন হলেও এ পোশাকটি ছিলো তখন ও।

১২৯৪-৯৫ সালে বিখ্যাত পর্যটক ও ইতিহাসবিদ মার্কো পোলোর লেখায় ও কার্পাস বস্ত্রের কথা পাওয়া যায়। এছাড়াও চতুর্দশ শতাব্দীতে যখন ইবনে বতুতা সোনারগাঁও এ আসেন তখন ও ছয় ধরণের বস্ত্রের প্রশংসা করেন এবং ষোড়শ শতাব্দীতে চীনা পরিব্রাজক গণ ও বিভিন্ন রচনায় বাংলার বস্ত্রশিল্পের কথা তুলে ধরেছেন। অনেক ঐতিহাসিক রা মনে করেন, খ্রিষ্টজন্মের ও কয়েকশত বছর আগে থেকে বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে বস্ত্র রপ্তানি হতো, অর্থাৎ বাংলাদেশ এর অর্থনীতিতে তাঁতশিল্পের একটি শক্তপোক্ত অবস্থান ছিলো সব সময় ই।

তবে মূলত শাড়ি বা পোশাক এর আমূল পরিবর্তন আসে মুঘল আমলে যাকে টেক্সটাইল যুগের স্বর্ণযুগ বলা হয়। সেই সময়ে যেমন বিভিন্ন ফেব্রিক এ বিভিন্ন রকমফের আসত থাকে তেমনি নানার রঙ এ ঢং এ তা শোভা ও পেত পোশাকে৷ সেই সময় ষোল হাতের শাড়ির ও প্রচলন ছিলো৷ মসলিন তো হয়ে গিয়েছিলো সারা বিশ্বের জন্য বিস্ময়৷ এতটাই প্রসিদ্ধ হয়ে উঠেছিলো যে ইউরোপীয় বণিকরা ছুটে এসে এখানে বসতি গড়ে তোলে যা কালক্রমে আমাদের জন্য ভালোর পরিবর্তে ক্ষতির ই কারণ হয়ে দাঁড়ায়৷ ইংরেজ শাসনের সময় তো শাড়ির সাথে সায়া, ব্লাউজ এর প্রচলন ও হতে শুরু করেছিলো৷

মসলিন বিলীন হয়ে গেলেও বাংলার তাঁত তার জায়গায় আধিপত্য বিস্তার করেই ছিলো৷ ভারত বিভাগের আগেই এদেশের নারীরা শাড়ি পরার চলন রপ্ত করে, তা মূলত ঠাকুর বাড়ির জন্যই সম্ভব হয়।। তাঁত এর শাড়ির বিস্তার হয় তখন অনেক বেশি৷ বিভিন্ন স্টাইল এ তাঁত এর শাড়ির শোভা পায় তখন কেননা ষাট এর দশকে নায়িকারা শাড়িকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন৷ বিভিন্নভাবে তারা শাড়ি তুলে ধরতেন বড় পর্দায় আর সেখানে থেকেই সাধারণ নারীরা ও তাদের ই অনুসরণ করতে শুরু করে৷ এভাবে ধীরে ধীরে শাড়ির আধুনিকায়ন হয়।।

ভারত বিভাগের পর পাকিস্তান শাসনামলে তাঁতশিল্পের তেমন উন্নতিসাধন না হলেও  বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর থেকে তাঁতশিল্পের বিকাশে সরকার এর পক্ষ থেকেই বিভিন্ন ধরণের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় এবং এই লক্ষ্যকে সামনে রেখেও ১৯৭৭ সালে তাঁতবোর্ড ঘটিত হয়৷ তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ সহ সুতার মূল্য বৃদ্ধি, পণ্যমূল্য হ্রাস, তাঁতীদের আর্থিক সংকট সহ বিভিন্ন কারণে তাঁতশিল্প বাঁধাগ্রস্ত হলেও আধুনিক বিপনন ব্যবস্থা ও দেশীয় তাঁতশিল্পের প্রতি সাধারণ মানুষের আগ্রহ ও তাঁত বস্ত্রের গুণগত মান এর কারণে আবার ও তাঁতবস্ত্রের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়েছে।৷ তাঁতী,  যারা তাঁত বুনেন তারা কখনো আশাহত হননি এবং পূর্বপুরুষ দের এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সব সময় ই চেষ্টা করে গেছেন।

টাঙ্গাইল এ তাঁতীদের আগমন ও তাঁতের শাড়ির সূচনাঃ

তাঁত নিয়ে যখন ই আলোচনা হয় তখন ই শুরুতে নাম চলে আসে টাঙ্গাইল এর তাঁত এর শাড়ি৷টাঙ্গাইল জেলা মানেই তাঁত এ সমৃদ্ধ৷ শুরু থেকেই এমন ছিলোনা টাঙ্গাইল জেলা বা এখানকার তাঁত৷ প্রায় ৫৫০ বছর এর ও আগে।   

যারা তাঁত বুনেন অর্থাৎ তাঁতী বা তন্তুবায় তাদের যে পূর্বপুরুষ তাদের আগমন ঘটে এ দেশে, সিন্ধু নদের পাশে জনবসতি থেকে প্রথমত তারা আসে রাজশাহী জেলার চাপাইনবাবগঞ্জ এর দিকে। কিছু রাজিশাহীতে ও থাকে৷ মূল পেশা যেহেতু বস্ত্রবয়ন ছিলো তাই তারা তাদের উপযুক্ত পরিবেশ খুঁজতে থাকে৷ এমন একটা জায়গা যেখানে আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ রকম কেননা শাড়ি বা পোশাক এর সাথে পরিবেশের দারুণ একটা ঐক্যতান আছে।

সেই রাজিশাহীর আশেপাশে থেকে তারা কিছু চলে যায় কিশোরগঞ্জ এ, কিছু ঢাকার তাঁতীবাজার এ৷ তাঁতীবাজার থেকে আসে ধামরাই এ। এরপর ও তারা খুঁজতে থাকে শাড়ি বুনন এর জন্য উপযুক্ত জায়গা। এভাবে এক সময় তারা চলে আসে টাঙ্গাইল এ,  এখানে নদীর পাড় জুড়ে বসতি  গড়ে এবং এই আবহাওয়া তে নিজেদের মনের মত করে শাড়ি তৈরি করতে পারে৷ দুটো গ্রুপ এ তারা এখানে আসে, একদম ধামরাই থেকে অন্য একটি দল ধামরাই এর চৌহাট্টা থেকে।

 টাঙ্গাইল এর ১২ টি উপজেলার প্রায় প্রতিটি উপজেলাতেই রয়েছে তাঁতীদের বসবাস, এছাড়া দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকেও কর্মচারী রা কাজ করে টাঙ্গাইল এ বিভিন্ন কারখানায়।  টাঙ্গাইল এর মিহি শাড়ি সবথেকে বেশি বিখ্যাত এবং তাঁত সমৃদ্ধ গ্রাম গুলো হলো সদর উপজেলার বাজিতপুর ও সন্তোষ, দেলদুয়ার উপজেলার চন্ডি, পাথরাইল, নলসোঁধা, নলুয়া, দেউজান ও বকুলতলা।

এছাড়াও মোটা তাঁতের শাড়িও প্রস্তুত হয় টাঙ্গাইল এ ই। সদর উপজেলার বিন্যাফৈর, বেলতা, বড় বেলতা, কালিহাতী উপজেলার বল্লা, রামপুর, কুকরাইল এসব গ্রামে মোটা তাঁতের শাড়ি ও তৈরি হয়।

হিন্দু তাঁতীদের ই আধিপত্য ছিলো যারা বিভিন্ন বংশের ছিলেন যেমন বারাস, বসাক, ননলন্দী, প্রামাণিক, পাল, শীল, সরকার,  সাধু এমন। পরবর্তীতে মুসলমান দের মাঝেও অনেকেই এটাকে পেশা হিসেবে নেন এবং মুসলমান তাঁতীদের বলা হয় জোলা। এই জোলা তাঁতীরা বেশিরভাগ ই ছিলেন টাঙ্গাইল, কালিহাতী ও গোপালপুর এলাকায়।

টাঙ্গাইল এ যুগের পর যুগ তারা তাঁত বুনে আসছেন। বেশিরভাগ জায়গা জুড়ে বসতি ও ছিলো বসাক দের, তারা বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও দিতেন সেই সময় যাতে এই তাদের যে কারিগরি নৈপুণ্য তা টিকে থাকে, তবে ১৯৪৭ এর দেশ ভাগ ও ১৯৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় অনেক তাঁতী ভারতে চলে যান এবং সেখানে গিয়েও তাঁত ই বুনেন। অর্থাৎ আমাদের দেশ থেকেই অনেক সম্প্রদায় গিয়ে সেখানে ভারতীয় শাড়ি বুনেন যার শুরু এ দেশেএ মাটিতেই ছিলো, তবু আমরা অনেক সময় ই বিভিন্ন শাড়িকে ভারতীয় তকমা দেই যা আসলে  আমাদের তাঁতীদের ই তৈরি ছিলো।

মসলিন এর উত্তরসূরী ছিলো টাঙ্গাইল এর তাঁতী রা,  যারা কিনা মসলিন বুনতো, জামদানী ও বুনতো কিন্তু এক সময় পরে এসে সুতি শাড়ির প্রাধান্য এত বেড়ে যায় যে টাঙ্গাইল এর তাঁত বলতে সুতি শাড়িকেই বুঝতে থাকে সবাই। ৯০ দশকের পর এসে তা আবারো পরিবর্তিত হয়, সুতি শাড়ির পাশাপাশি সফটসিল্ক, হাফসিল্ক শাড়ি সহ অন্যান্য অনেক শাড়ি ধীরে ধীরে ব্যাপক প্রসার লাভ করে৷ ডবি ও জ্যাকার্ড মেশিন আবিষ্কার হওয়ার পর থেকে জটিল ডিজাইন গুলো ও তাঁত এ উঠতে থাকে অপেক্ষাকৃত কম সময়ে, যার ফলে তাঁতশিল্পে আসে ব্যাপক পরিবর্তন। 

টাঙ্গাইলের শাড়ির রকমফের

টাঙ্গাইল এ বিভিন্ন ধরনের শাড়ি তৈরি হয়, তা যেমন বিভিন্ন তাঁত এ তৈরি হয়, তেমনি বিভিন্ন ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করে নানান ধরণের ডিজাইন এ। একেবারে রঙ এর খেলা লেগে থাকে সারাক্ষণ তাঁতীপাড়ার আশেপাশে।। এখানে যে সকল তাঁত এ কাপড় বোনা হয়। তা হলো

  • পিট লুম বা গর্ত তাঁত
  • ফ্রেম লুম
  • চিত্তরঞ্জন বা জাপানি তাঁত
  • এছাড়াও অর্ধমেশিন তাঁত এবং পাওয়ার লুম ও আছে।

সবথেকে আঁদি তাঁত হলো পিটলুম বা গর্ততাঁত, যা তৈরি হতো বাঁশ কাঠ বা হাতের কাছে পাওয়া যায় এমন সহজ দ্রব্যাদি দিয়েই। এই তাঁত এর সঙ্গেই পরবর্তীতে যোগ হয়েছে ফ্লাই সাটল। আর এর ফলে মাকুকে আগের মত হাত দিয়ে ছুড়তে হয়না, মাকু একটি টানেলের মধ্যে থাকে এবং তাঁতী দড়ির সাহায্যে টানলে মাকু চলে এবং খটখট করে শব্দ হয়, যার কারণে এ তাঁত কে খটখটি তাঁত ও বলা হয়৷  এতে কাজ আগের থেকে দ্রুত হয়। 

গর্তে বসানো লাগেনা এমন খটখটি তাঁত ও আছে, যা শুধু তাঁত নামে পরিচিত। এটার আঞ্চলিক আপডেটেড ভার্সন কে হ্যান্ডলুম বলা হয়। মর্টার যুক্ত করে এসব তাঁত কে সেমি অটোমেটিক ও করা হয়েছে অনেক জায়গায় যা দ্রুত চলে এবং  এর উৎপাদন ও বেশি।  আবার যেগুলো ২৪ ঘন্টা চলে এমন ও আছে যা মেশিনতাঁত বা পাওয়ারলুম নামে পরিচিত।

বাংলাদেশে ডবি ও জ্যাকার্ড মেশিন এসেছে  অনেক পরে তবে এর ফলে তাঁতশিল্পে নতুন দিগন্তের আবির্ভাব হয়েছে। অনেক অনেক ডিজাইন যেমন তৈরি হচ্ছে তা তাঁতীদের জন্য অনেক সুবিধা ও নিয়ে এসেছে। তাঁতশিল্প ও এগিয়েছে।

টাঙ্গাইল এ ব্যবহৃত তাঁত এর সুতার কাউন্টঃ

টাঙ্গাইল এ  শাড়ি তৈরিতে ডিজাইন ভেদে, কোয়ালিটি ভেদে বিভিন্ন কাউন্ট এর সুতা ব্যবহার করা হয়। তাঁত এর শাড়ি তৈরিতে সুতার যে একক হিসেবে সুতা কে বিবেচনা করা হয় তাই কাউন্ট। সুতার কাউন্ট যত বেশি সুতা তত বেশি সূক্ষ্ম হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ১৮০, ৮২, ৮৪ কাউন্ট সুতা ব্যবহার করা হয়।  তবে ৬০, ৬২, ৭৪ কাউন্ট এর ও সুতা ব্যবহার করা হয়।

টাঙ্গাইল এর কালিহাতি তে ই আছে সুতা প্রস্তুত করার কারখানা। এখান থেকেও সুতা আনা হয় বা নারায়ণগঞ্জ সহ অন্যান্য অনেক জায়গা থেকে সুতা আনা হয়।

টাঙ্গাইলের শাড়ি তৈরির বিভিন্ন ধাপঃ

তাঁত এর শাড়ি মানেই তাঁতীদের হাতের ছোঁয়ায় তৈরি হয় প্রতিটি শাড়ি৷ তবে তাঁত এ সুতা বসানোর আগেও অনেক গুলো ধাপ অতিক্রম করতে হয়।  সেই ধাপগুলো ও এখানে কিছুটা তুলে ধরার চেষ্টা করছি আমি।

যে ম্যাটেরিয়াল এর শাড়ি বুনন হবে সেইমত সুতা কিনে আনা হয় প্রথমত কারখানায় বা তাঁতীবাড়িতে৷ সেই সুতা মসৃণ করার কিছু ধাপ এখানেই সম্পন্ন হয়। সুতা যেহেতু নরম একটি জিনিস যা তাঁত এ তুলতে হয়, টান টান থাকে তাই সেই উপযোগী করতে সুতাগুলোকে মাড় দেয়া হয়, তাঁতীদের ভাষায় পাড়ি দেয়া।

 পরবর্তী তে আসে রং করার পালা। গরম পানিতে বিশেষ পদ্ধতিতে চুবিয়ে জ্বাল দিয়ে রঙ করা হয়৷ খুব ই সাবধানে সঠিক পরিমাণ রঙ মেশাতে হয় কেননা রঙ এর পরিমাপ এর কম বেশিতে রঙ পরিবর্তন হয়ে যায়৷ এরপর তা শুকাতে হয় খোলা জায়গায়। রোদ থাকলে একদিনেই শুকিয়ে যায় নাহলে দুইদিন সময় লাগে। মাঝে মাঝে সুতা গুলো এদিক সেদিক নেড়ে দিয়ে আসতে ও হয়। প্রতিটা ধাপেই আসলে কড়া নজরদারির বেশ প্রয়োজন। 

 এসব সুতা কেউ বা চরকায় সুতা কাটে, কেউবা ববিন এ সুতা তোলে তা আবার ড্রাম এ পাকানো হয়, কেউ সুতা টানা দেয়, এই টানা দেয়া সুতা গুলো নাটাই এ ঢুকানো হয়, একসাথে ২০ থেকে ২২ টি সুতার টানা দেয়া যায়৷

এখানে এক ধাপে ড্রাম মাস্টার রা সুতা প্রসেসিং করে। এরকম অনেক ধাপ সম্পন্ন করে সুতা তাঁত এ তোলা হয়। তবে কোন সুতা, কি পরিমাণ সুতা তাঁত এ তুলতে হবে তার আগে যে শাড়ি করা হবে তার ডিজাইন তৈরি করতে হয়৷ এই কাজ করে একজন নকশাকার৷ গ্রাফ এ ডিজাইন কাটে তা হাতেও করে এখন কম্পিউটার এ ও করা হয়৷ নকশা র সেই মালা তাঁত এ যুক্ত হয়৷ এই নকশার মালা কাপড় বোনা শেষ হলে কাগজ পরে যায় এবং পরে আবারো নতুন করে তোলা হয়। এভাবেই তৈরি হয় একটি শাড়ি৷

নকশা ভেদে সময় কম বেশি লাগে। কোন কোন শাড়ি বুনতে দুই দিন বা তিন দিন লাগে আবার কোন শাড়ি উঠাতে দুই তিনমাস ও সময় লেগে যায়, আবার টাঙ্গাইল এর তাঁত এ এতটাই মানসম্মত শাড়ি  তৈরি হয় যা এক বছর ও সময় লাগে তবে তা খুব কম এবং চাহিদা অনুযায়ী। 

আগে শাড়ির নকশা র জন্য পাকানো সুতা ব্যবহার করা হতো তবে এখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই  রেয়ন, জরি, মেটালিক জরি ব্যবহার করা হয়। জরির সুতা টানা দেয়ার সময় এর সাথে খান্দি নামের রোল ব্যান্ড ব্যবহার করা হয় এবং যখন হাফসিল্ক বা সিল্ক টাইপ ম্যাটেরিয়াল লাগে তখন সিল্ক সুতার খান্দি ব্যবহার করা হয়। এগুলো সব ই আলাদা আলাদা ধাপে প্রস্তুত করা হয়।

টাঙ্গাইল এ যেমন তাঁত এ ই তোলা হয় বিভিন্ন ডিজাইন। অসংখ্য ভ্যারাইটি তেমনি প্লেইন শাড়ি ও তাঁত এ হয়। অনেক জায়গায় এসব শাড়িতে তাঁত থেকে বের করেও বিভিন্ন সেলাই এ রাঙানো হয়। রানিং স্টীচ, ক্রস স্টীচ, সাটিন স্টীচ, চেইন স্টীচ, কাশিদা, কারচুপিসহ বিভিন্ন ধরনের সেলাই দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয় নকশা।

প্রস্তুতকৃত শাড়ি গুলো ইস্ত্রি করে ভাঁজ করা হয়,  অনেক সময় উলটো পাশের সুতো কাটার প্রয়োজন হয়,  সেগুলো কাচি দিয়ে কাটা হয়, এখন অবশ্য কাঁচির পরিবর্তে আধুনিক যন্ত্র ও পাওয়া যায় যা দিয়ে এই সুতো কাটা হয়৷

এই এত এত ধাপের পর তৈরি হয় টাঙ্গাইল এর শাড়ি যার দাম যেমন ৪০০ হয় তেমনি ৪০০০০ ও হয়। এমনকি এখন লাখ টাকার শাড়ি ও তৈরি হয় টাঙ্গাইল এ৷

টাঙ্গাইল এর বিভিন্ন ধরণের তাঁত এর শাড়িঃ

টাঙ্গাইল এর শাড়ি মূলত সুতি, হাফসিল্ক, সিল্ক এসব ম্যাটেরিয়াল দিয়ে তৈরি হয় যা বুনন পদ্ধতির কারণে বা  ডিজাইন এর ভিন্নতা অনুযায়ী নামকরণ হয়। এমন অনেক অনেক শাড়ি আছে টাঙ্গাইল এ। এর সব বা একদম সঠিক নামকরণ বা সঠিক সংখ্যা হয়তো গণনা কোথাও সম্ভব হয়নি তবে এখানে জানা বা অজানা বেশ কিছু শাড়ির নাম ই তুলে ধরবো।

  1. টাঙ্গাইল এর পিউর সুতি শাড়ি
  2. এন্ডি কটন শাড়ি
  3. স্ল্যাব কটন শাড়ি
  4. সুতি তন্তুজ শাড়ি
  5. হাফসিল্ক জামদানী শাড়ি
  6. সুতি জামদানী শাড়ি
  7. দোতার জামদানী শাড়ি
  8. টিস্যু জামদানী শাড়ি
  9. জামদানী সিল্ক
  10. খেশ শাড়ি
  11. কটকি শাড়ি
  12. মাসলাইস সুতি শাড়ি
  13. মাসলাইস কটকি শাড়ি
  14. মাসলাইস কোটা শাড়ি
  15. মাদুরাই কটন শাড়ি
  16. হাফসিল্ক মাদুরাই শাড়ি
  17. চুমকি শাড়ি
  18. হাজারবুটি শাড়ি
  19. কোটা শাড়ি
  20. পপকর্ন কোটা শাড়ি
  21. গ্রামীণ চেক
  22. বিভিন্ন ধরণের স্ট্রাইপ শাড়ি
  23. গামছা শাড়ি
  24. ঝর্ণা শাড়ি
  25. বালুচুরি শাড়ি
  26. সুতি থামি শাড়ি
  27. টুইসটেড কটন শাড়ি
  28. পাটি শাড়ি
  29. জুম শাড়ি
  30. রংধনু পাড় শাড়ি
  31. ধুপিয়ান শাড়ি
  32. সফট সিল্ক শাড়ি
  33. পিউর সিল্ক এর সাথে শিবুরি ডিজাইন
  34. কাতান সিল্ক শাড়ি
  35. বেনারসি সিল্ক শাড়ি
  36. তসর সিল্ক শাড়ি
  37. মসলিন থান শাড়ি
  38. মসলিন এমব্রয়ডারি শাড়ি
  39. হাটুপাড় শাড়ি
  40. প্লাস পাড় শাড়ি
  41. জবা পাড়
  42. জরি পাড় শাড়ি
  43. ঝুরি চেক শাড়ি
  44. কাঁথা স্টীচ শাড়ি
  45. জরি শিকল পাড় শাড়ি
  46. দাবা কোট পাড় শাড়ি
  47. বলপ্রিন্ট শাড়ি
  48. গঙ্গা যমুনা পাড় শাড়ি
  49. ড্যাংগু শাড়ি
  50. জুট কাতান শাড়ি
  51. পাটের শাড়ি
  52. তুন্দন
  53. ঝলক কাতান
  54. স্বর্ণকাতান
  55. ধানসিঁড়ি শাড়ি
  56. টাঙ্গাইল বি.টি শাড়ি
  57. ময়ুরকন্ঠি শাড়ি

এমন আরো বিভিন্ন ধরণের শাড়ি বুনন হয় টাঙ্গাইল এ৷ কিছু শাড়ি নিয়ে সামান্য আলোচনা তুলে ধরবো এখানেঃ

টাঙ্গাইল এর পিউর সুতি শাড়িঃ

খুব ছোট্টবেলা থেকে মা, দাদী-নানী দের মুখে সবথেকে বেশিন্যে শাড়ির গল্প শোনা হয়েছে সেটাই টাঙ্গাইল এর সুতি শাড়ি। ঘরোয়া পরিবেশের জন্য যেমন উপযোগী তেমনি বাহিরে ফরমাল লুক মানেও এই শাড়ি৷ টাঙ্গাইল এর শাড়ি বিখ্যাত ই এর সূক্ষ্ম বুনন এর জন্য আর তাইতো ভীষণ নরম ও মোলায়েম হয় ।  বছরের যেকোন সময় এর জন্য দারুণভাবে মানিয়ে যায় এ শাড়িগুলো৷

পাড় এর কাজ এবং আচল সব সময় ই আলোচিত টাঙ্গাইল এর শাড়ির তবে এখন পুরো বডি জুড়েই থাকে সুন্দর নকশা। এক সময় বারো হাতেই সউ ছিলো এ শাড়িগুলো আর এখন তা সাড়ে তেরো হাত, ১৪ হাত ও হয়। ব্লাউজ পিছ ও রানিং হিসেবে দেয়া ই থাকে বেশিরভাগ সুতি শাড়িতে।

সুতি বলত শুদ্ধু প্রিন্ট না, তাঁত এর সুতি শাড়িতে পাড়ের নকশা অনুযায়ী নামকরণ ও হয়। শাড়িগুলোতে মানানসই কালার এর সাথে পাড় আর আচলে মনোমুগ্ধকর ডিজাইন টাঙ্গাইল এর শাড়িকে বিশ্বে সমাদৃত করেছে।

পাড় ও আচলে দাবার কোট এর ডিজাইন, পানপাতা, স্কুয়ার শেপ, জামদানী কল্লা পাড়, প্লাস পাড়, জবা বা বিভিন্ন ফুল লতাপাতার ডিজাইন এর ভিন্নতায় নানান নামে চলে আসে এই সুতি শাড়িগুল৷

কিছু শাড়িতে এখন কুচিতে আলাদা ভাবে ও ডিজাইন করা থাকে যা সুতি শাড়িকে অনন্য এক রূপ দেয়। তাঁতীদের মেধা ও কাজে দিন দিন ভ্যারিয়েশন বেড়েই চলছে এবং তাঁতশিল্প নিয়ে সাধারণ মানুষদের ও জল্পনা কল্পনা বাড়ছে। হাতের তাঁত, মেশিন তাঁত সব ধরনের তাঁতেই সুতি শাড়ি তৈরি হয় অবিরাম।

এন্ডি কটন শাড়িঃ

টাঙ্গাইল এ এন্ডি আচল এর বেশ কিছু শাড়ি হয়। আচল টা পুরো শাড়ির সৌন্দর্য ভিন্ন ভাবে প্রকাশ করে এন্ডি কটন এ। তবে একেবারেই অরিজিনাল যে এন্ডি সেটি মূলত টাঙ্গাইল এ হয়না কেননা এন্ডি মানেই অনেক বেশি প্রাইস যা পসিবল হয়না বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যার কারণে কটন থান এ বা প্লেন কিছুতে এন্ডি ব্যাবহার  করা হয় আচলে। বিভিন রঙ এবং অত্যন্ত সুন্দর ফিনিশিং ও এর হালকা ওজন এর জন্যই সবার পছন্দের জায়গা নিয়েছে এই এন্ডিকটন শাড়িগুলো।

পাওয়ারলুম, হ্যান্ডলুম দুই ধরণের তাঁত এ ই এগুলো তৈরি হয়।

স্ল্যাব কটনঃ

স্ল্যাব কটন এখন অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি নাম। এই শাড়িগুলো এত আরামদায়ক এবং বুনন এত সুন্দর যেন মনে হয় পুরো শাড়িজুড়েই শান্তি একটা ভাব বিরাজ করে। স্ল্যাব কটন এর শাড়িগুলোতে বিভিন্ন ধরনের লতাপাতা, ফুল এর ডিজাইন উঠানো হয়। এই ডিজাইন গুলো সুতোতে তোলা হলেও এত সূক্ষ্ম বুনন থাকে যেন মনে হয় কেউ এতে ব্লক করেছে বা তুলিতে ছুয়ে দিয়েছে। স্ল্যাব সুতা টা যেমন মোটামুটি রেঞ্জ এর শাড়ি তে ব্যবহার করা হয় তেমনি এটি দামী শাড়িতেও ব্যবহার করা হয়।

তন্তুজ শাড়িঃ

টাঙ্গাইল এর তাঁত এর শাড়ির অনন্য একটি নাম সুতি তন্তুজ।  এই শাড়িগুলো প্রাকৃতিক এক ধরনের ফাইবার থেকে প্রাপ্ত সুতা দিয়ে তৈরি যার ফলে অনেক নরম ও ভীষণ আরাম এর৷ শাড়িগুলোতে তাঁত মেশিনেই সুন্দরভাবে ফুল ফুটিয়ে তোলা হয়, এত সুন্দর কারুকাজ হয় যা টাঙ্গাইল এর শাড়ির জগতে অন্যমাত্রা দিয়েছেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পাওয়ারলুম এ তৈরি হয় এই শাড়িগুলো এর একটা ই কারণ এর ম্যাটেরিয়াল এত ভালোমানের যে হাতে বুনন করলে একদিকে যেমন সময় বেশি লাগবে অন্যদিকে শ্রমিক মজুরি ও অন্যান্য কিছু মিলিয়ে এর ব্যয় হয় অনেক বেশি৷

প্রাইসিং ও খুব বেশি হয় যা সবাই বহন করতে পারেনা তাই মোটামুটি রেঞ্জ এ রাখতে এ শাড়িগুলো মেশিনেই বোনা হয়। অন্যান্য শাড়ির তুলনায় বহর ও বেশি এবং পুরো শাড়ি জুরে ফুল, লতা পাতা সহ ইদানীং গ্রামের দৃশ্য ও ফুটিয়ে তোলা হয় এসব শাড়িতে।

টাঙ্গাইল এর জামদানী শাড়িঃ

জামদানী মানেই বাঙ্গালী নারীর কাছে ওকটি আবেগময়ী নাম। টাঙ্গাইল এর তাঁতীদের পূর্বপুরুষ রা মসলিন বুনতো এবং মসলিন এর যুগ শেষ হলেও মসলিনের একটি অংশ জামদানী রয়েই গেছে আমাদের দেশে। জামদানীর জন্য নারায়নগঞ্জ এর রূপগঞ্জ প্রসিদ্ধ হলেও টাঙ্গাইল এর তাঁতীদের হাতের জামদানী ও অত্যন্ত সুন্দর ও জনপ্রিয়। তাঁতীদের নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় খুব আরামদায়ক, বিভিন্ন ডিজাইন এর নানান রঙ এর জামদানী তৈরি হয় এখানে। মূলত এখানকার জামদানী গুলো এসব নামেই পরিচিতঃ

  • সুতি জামদানী
  • হাফসিল্ক জামদানী
  • সিল্ক জামদানী
  • মসলিন সিল্ক জামদানী
  • তসর জামদানী
  • ফ্লোরপ্লাই জামদানী
  • ডেনু জামদানী

রেয়ন, জরি সুতা ও উন্নতমানের মোলায়েম সুতা সহ বিভিন্ন ম্যাটেরিয়াল এ তৈরি হয় এখানকার জামদানী। ক্রেতাদের সাধ ও সাধ্যের যাতে সমন্বয় হয় সেভাবেই খুব কমমূল্যের জামদানী থেকে অনেক বেশি মূল্যের জামদানী শাড়ি তৈরি হয় এখানে।।  অনেক ডিজাইন এর মাঝে টাঙ্গাইল এর শাড়ির রাজধানী খ্যাত পাথ্রাইল ঘুরলে দেখা যায় কয়েক  ধরণের  জামদানী ডিজাইন প্রাধান্য পায়। যেমনঃ

  • ঢেউ
  • আম
  • রহিতন
  • দোতারা
  • ডাবল আম
  • ডেমরা

সুতার কাউন্ট এর ভিন্নতা আছে অনেক। মূলত এখানকার জামদানী শাড়ি তৈরির জন্য ৮০/১, ৮২/১, ১০০/১, ১০০/২ কাউন্ট এর সুতা ব্যবহার করা হয় তবে টাঙ্গাইল এ তাঁতীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ৮২/১ ও ৮৪/১ কাউন্ট এর সুতা ব্যবহার করে থাকে।

জামদানী শাড়ি মেশিনলুম এ ও তৈরি হয় এবং হাতের তাঁত এ ও তৈরি করা হয়। সাধারণ মানের একটি শাড়ি তৈরি করতেও একদিন সময় লাগে তবে এক্ষেত্রে তাঁতীর শ্রম যায় বেশি নাহলে দুইদিনে একটি শাড়ি তৈরি সম্পন্ন হয়৷

এছাড়াও ডিজাইন এর উপর নির্ভর করে জামদানী শাড়ি যেমন ৩-৪ দিন লাগে তেমনি এক মাস বা দুই তিন মাস সময় ও লেগে যায়। তবে যত সূক্ষ্ম ডিজাইন,  যত ভারী কাজ সময় তত বেশি এবং দাম ও অনেক বেশি৷ এক বছর সময় লাগে যার মূল্য ৮০০০০ এর কাছাকাছি বা পাশাপাশি এমন জামদানী ও তৈরি হয় টাঙ্গাইল এ৷ আসলে এ শাড়িগুলোতে যেমন কাজ সুনিপুণ হয় তেমনি কারিগর এর মজুরি তে ও দাম বাড়তে থাকে৷ তবে টাঙ্গাইল এর জামদানী গুলোর আলাদা বিশেষত্ব আছে শাড়ির জগতে।

খেশ শাড়িঃ

ঐতিহ্যের সাথে মিশে আছে আমাদের তাঁতশিল্প আর এই তাঁতশিল্পের মধ্যে বিশেষ কিছু শাড়ি আছে যা আমাদের সেই ঐতিহ্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় সব সময়।  তেমনি একটি নাম খেশ শাড়ি।

টাঙ্গাইল এর তাঁতীরা তৈরি করেন এ শাড়ি যার সাথে সাথে সরাসরি যুক্ত আছে আমাদের কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর নাম। বর্তমানে যে খেশ তার হাতে খড়ি হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর শান্তিনিকেতন এর বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের তাঁতীদের হাত ধরে। সেই নিয়মেই এখনো তৈরি হচ্ছে খেশ।

এটি একটি রিসাইক্লিং পণ্য। পুরনো সুতি শাড়ির ফালি থেকে তৈরি হয় নতুন একটি খেশ শাড়ি। প্রথমে পুরাতন শাড়ি ছিঁড়ে ছোট দড়ির মত করে পেঁচিয়ে ফালি করা হয়। একেকটি সুতি শাড়ি থেকে প্রায় ৮০ থেকে ৮৫ টি র মত এমন ফালি পাওয়া যায়। সেই ফালিগুলোকে চরকায় ফেলে সমান করে বসানো হয়। 

এগুলো থেকেই তৈরি হয় খেশ শাড়ি। পুরাতন শাড়ি থেকে এই ফালি নেয়া হয় জন্য অরিজিনাল খেশ এর কালারগুলো কখনোই সেইম টু সেইম হয়না কেননা এই ফালির কালার কখনোই ফুললি মেলানো সম্ভব না। পুরনো কাপড় মানেই আরামের তাই খেশ খুব স্বাভাবিক ভাবেই অত্যন্ত আরামদায়ক একটি পোশাক। ২০০ বছর ওর পুরাতন এ ঐতিহ্য হারিয়ে ই যেতে বসেছে যা আবারো প্রাণ ফিরে পাচ্ছে ই-কমার্স এর ছোঁয়ায়, চিনছে জানছে অনেকে এবং খেশ ওর প্রতি আগ্রহী ও হচ্ছে৷

কটকি শাড়িঃ

সাদা সুতা কে বিভিন্ন রঙ এ রাঙিয়ে টাঙ্গাইল এর তাঁতীদের হাত ধরে বিভিন্ন ধরনের, বিভিন্ন নামের শাড়ি তৈরি হয়। কটকি এর মাঝে অন্যতম একটি শাড়ি এবং শাড়িপিয়াসি দের কাছে খুব পরিচিত একটি নাম। খুব ই উন্নতমানের সুতা থেকে তৈরি হয় এই কটকি তাই পরতে ও যেমন আরাম,  সুন্দর ও।

এর জ্যামিতিক নকশা ই এর রূপের প্রধান রহস্য৷ এই নকশা টা শাড়ি কে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। অন্যান্য শাড়ি তে যেমন রঙ করে নকশা তোলা হয় তাঁত এ, কটকি র ক্ষেত্রে তা অনেক ভিন্ন। কটকি শাড়ির ক্ষেত্রে সুতা রঙ করার সময় তা করা হয় একটি বিশেষ প্রক্রিয়ায়। সাদা সুতাগুলোকে দুই ইঞ্চি পর পর কস্টেপ দিয়ে বেঁধে পরে ডাই করা হয়। সুতা শুকানোর পর সেই কস্টেপ গুলোকে খুলে দেয়া হয়,  এর ফলে কস্টেপ মোড়ানো জায়গা সাদা হয় এবং বাকি জায়গা রঙীন,  এর পর এই সুতা তাঁত এ তুলে বোনা হয় কটকি শাড়ি৷

সুতার ভিন্নতায় বিভিন্ন ধরণের কটকি রয়েছে৷ যেমনঃ

  • সুতি কটকি
  • মাসলাইস কটকি
  • হাফসিল্ক কটকি
  • সিল্ক কটকি
  • পঞ্চকলি কটকি

কটকি শাড়ি গুলো এত আরামদায়ক এবং পরার পর ক্ল্যাসি লুক দেয়ার কারণে দিন দিন এর জনপ্রিয়তা বাড়ছেই,  আমাদের টাঙ্গাইল এর তাঁতীরা এভাবেই বিভিন্ন মানসম্মত শাড়ি বুনে তা আমাদের গর্বের জায়গায় পরিণত করেছে।

মাসলাইস কটন শাড়িঃ

মাসলাইস এই নামটা মনে হলেই একটা দারুণ আরাম আরাম অনুভূতি হয় কারণ যারা ই মাসলাইস শাড়ি ব্যবহার করেছেন খুব সহজেই বোঝা যায় যে কতটা আরামদায়ক একটি শাড়ি এটি।

১৮৪৪ সালে জন মার্সার নামক একজন ব্যক্তি প্রথম দেখেন যে সুতাকে কস্টিক সোডা দ্রবণের মাঝে দিয়ে ৫৫-৬৫ ডিগ্রী কোয়াডেল তাপমাত্রায় অতিক্রম করানো হলে সুতার মান, উজ্জ্বলতা, স্থায়িত্ত্ব,  শক্তি বৃদ্ধি পায়। এর স্থায়িত্ব বাড়ার পরিমাণ প্রায় ২০-৩০%।  এর ফলে এই সুতা দিয়ে যখন তাঁত এ  শাড়ি  বুনন করা হয় তখন সেই শাড়ি অনেক বেশি শাইনি এবং সফট হয়। ফলে শাড়িগুলো অত্যন্ত আরামদায়ক হয়। এই যে সুতার মান পরিবর্তন এর এই পদ্ধতি একে মার্সেরাইজিং বলা হয়। জন মার্সার নামেই এই নামকরণ।

টাঙ্গাইল এর তাঁত এ ঠিক কবে থেকে এ শাড়ি বুনা শুরু হয় তার সঠিক তথ্য না থাকলেও মাসলাইস খুব জনপ্রিয়৷ এক সময় মনে করা হতো এটা ইন্ডিয়ান কিন্তু এটি টাঙ্গাইল এ ই বোনা হয়৷।

জরি পাড়,  আচলে ডিজাইন এই শাড়ির অন্যতম বৈশিষ্ট্য।  প্রথমত পাড় আর আচলে ডিজাইন করে এক রঙ শাড়িই বেশি প্রচলিত থাকলেও এখন নানান ডিজাইন হয় মাসলাইস এ৷

পাড় এ পানপাতা, লাভ শেপ যেমন হয় তেমনি জমিনেও বিভিন্ন ডিজাইন এর ভিন্নতা এনেছে মাসলাইস শাড়িতে। লতাপাতা ডিজাইন, বলপ্রিন্ট, বিভিন্ন ধরণের চেক ডিজাইন এর ও মাসলাইস পাওয়া যায়।কোটা অত্যন্ত আরাম এর শাড়ি এর বুনন এ ও মাসলাইস সুতা দিয়ে ভালো মানের মাসলাইস কোটা তৈরি হয়। ভিন্নতার সাথে তাই দিন দিন এর গ্রহণযোগ্যতা বেড়েই চলছে।

কোটা শাড়িঃ

টাঙ্গাইল শাড়ি যারা খুব পছন্দ করেন এক নামে তারা কোটা শাড়ি চিনেন। বাসায় ব্যবহার থেকে শুরু করে অফিস কিংবা নিত্য প্রয়োজন এ বাহিরের সঙ্গী হয় এই কোটা শাড়ি গুলো৷ বাসায় মা কাকিদের শাড়ির সংগ্রহে কোটা শাড়ি থাকেই৷

কোটা শাড়ির শুরু রাজস্থানের কোটা নামক স্থানে, এখানে ১৭ শতজের মাঝামাঝি তে এই শাড়ির বুনন শুরু হয়। তারা চৌখুপী বুননের সাথে সাদৃশ্য রেখে সুতি কাপড়ে এই বুনন করতো। চৌখুপি ডিজাইন এর কোটাগুলো খুব ই জনপ্রিয় শাড়ি। আমাদের দেশেই  কোটা বোনা হয়, তাও প্রায় ২০-২৫ বছর আগে থেকে।

 কোটা শাড়িগুলো সিম্পল ও খুব ফরমাল একটা শাড়ি সাথে অত্যন্ত আরামদায়ক।  কোটার যে বুনন তাতে আড়াআড়ি  সুতার বুনন গুলো এমন যে মনে হয় যেন প্রতি বুননের পাশে জায়গা আছে বায়ু চলাচল এর জন্য, আর এ কারণেই কোটা শাড়ি অন্য যেকোন শাড়ির সাথে তুলনা করলে আরামে এগিয়ে। আসলে কোটা শাড়ির বুননে অয়েক সুতা পর পর ই একটা করে সুতা তুলে নেয়া হয় যাতে শাড়ি পাতলা হয় এবং হালকা হয়,  আর এ কারণেই কোটার মূল বৈশিষ্ট্যের সাথেই মিশে আছে আরাম শব্দটি।

এক সময় কোটা মানেই শুধু সুতি সুতা দিয়ে বুনন হলেও প্রয়োজনের সাথে পাল্লা দিয়ে এখন হাফসিল্ক এ ও কোটা তৈরি হয়৷ ইভেন খেশ এর মত কাঁথা সেলাই এর কায়দাকে কাজে লাগিয়ে এতেও শাড়ির ফালি দিয়ে দারুণ খেশ এর মত রূপ দেয়া হয়৷ কেউ যেমন একে কোটা খেশ বলে অনেকেই আবার পপকর্ণ কোটা বলে৷ নাম যেমন ই হোক কোটা সব সময় আরামদায়ক অনুভূতি ই দেয়৷ শান্তি স্নিগ্ধ রঙ এর এই শাড়িগুলোর  দাম টা একদম ই সাধ্যের মাঝে থাকে সব সময় ই৷

টাঙ্গাইল এর চেক শাড়িঃ

চেক এর একাল আর সেকাল নেই। সবকালে সমানভাবে জনপ্রিয় একটি শাড়ি।  এটি যেমন ফ্যাশন এর অংশ তেমনি ঐতিহ্যের ও সাক্ষর রেখে চলেছে দিনের পর দিন। শাড়ি না শুধু শার্ট, টপস, কূর্তি, ফতুয়া, ব্লাউজ, জামা সবকিছুতে সমানভাবে বিরাজমান চেক। বিশেষ করে গ্রামীণ চেক। বিভিন্ন প্যাটার্ন এ পাওয়া যায় এই চেক। সাধারণভাবে বোঝা না গেলেও চেক এর প্যাটার্নগুলোতে বেশ পার্থক্য রয়েছে। জিংহ্যাম চেক, পিন চেক, মাদ্রাজ চেক, প্লেইড চক, বারবেরি চেক ইত্যাদি৷ বাংলাদেশ এ সবথেকে বেশি জনপ্রিয় মাদ্রাজ চেক যা ভারতের মাদ্রাজ শহরের একটি ঐতিহ্যবাহী প্যাটার্ন।

গ্রামীণ চেক এর জনপ্রিয়তা নিয়ে হয়তো কিছু বলার ও নেই, নব্বই দশকের পর থেকে এর জনপ্রিয়তা প্রথম সারির দিকেই বিদ্যমান। গামছা শাড়ি, বিভিন্ন চেক বা গ্রামীণ চেক, ঝুরি চেক এগুলো প্রত্যেকটি র সাথে মিল পাওয়া গেলেও প্রত্যকটি শাড়ি তার জায়গায় নিত্যনতুন। চেক এর স্কয়ার প্যাটার্ন এ বিভিন্ন রঙ এর আধিক্য শাড়ির জৌলুস বাড়িয়ে দেয়, শাড়ি গুলো খুব আকর্ষণীয় হয়।

পূর্বে গ্রামীণ চেক বলতে শুধুমাত্র সুতি বুঝা যেত কিন্তু এখন অন্যান্য ম্যাটেরিয়াল এ তৈরি হয় চেক।  বিভিন্ন ধরণের স্ট্রাইপ শাড়িগুলো এই স্ট্রাইপ এর জন্যই পরার পর অত্যন্ত মার্জিত ও রুচিশীল লাগে দেখতে। টাঙ্গাইল তাঁত এ ও বহুলভাবে তৈরি হয় এ শাড়ি।

জুম শাড়িঃ

যুগে যুগে আমাদের দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের তাঁতীরা বুনে চলেছে বিভিন্ন ধরনের শাড়ি। এর ই ধারাবাহিকতায় জুম শাড়ি ও একটি। জুম মূলত পাহাড়িদের শাড়ি। সিলেটের শ্রীমঙ্গলের তাঁত এ বোনা ঐতিহ্যবাহী একটি শাড়ি।  তবে শুরুর দিকে এখানকার আদিবাসী মেয়েরা ছোট আকারে ওরনার মত তৈরি করতো কিন্তু পরবর্তীতে এটিকে শাড়ির সমআয়তন করে শাড়ি রূপ দেয়া হয় এবং প্রচুর জনপ্রিয়তা ও পায়।

জুম শাড়ির মূল বিশেষত্ব হলো এই শাড়িগুলো খুব ই হালকা এবং দেখতে অনেকটা সিল্ক এর মত। শাড়ির বুনন ফাঁকা ফাঁকা হয় তবে আসল জুম শাড়িতে বুনন এ ফাঁক থাকলেও ট্রান্সপারেন্ট না। বুননের এই ব্যাপারটি র জন্য এ শাড়ি অত্যন্ত আরামদায়ক।  শাড়িতে জরি সুতার স্ট্রাইপ এর মত থাকে আচলে যা শাড়ির চকচকে ভাবটা বাড়িয়ে দেয়।

এখন তো জুম শাড়ির মাঝেও নতুনত্ব আনছেন তাঁতীরা, এর মাঝে একটি হলো জুম শাড়িতে টেম্পল পাড়।

এ শাড়ির ম্যাটেরিয়াল এ মূলত কৃতিম সিল্ক বা রেয়ন, অনেকেই ভিসকোস ও বলে এবং লিনেন সুতার মিশ্রণ ও থাকে৷ সুতোটাই এমন যে ঠান্ডা ঠান্ডা একটা অনুভূতি দেয় শরীরে।

টাঙ্গাইল এর তাঁত এ বোনা জুম গুলোও অনেক পরিচিতি লাভ করেছে এবং সুলভ মূল্যে পাওয়া যায় ও ক্যারী করায় খুব সহজ তাই ক্রেতা সন্তুষ্টি তে খুব বেশি সাড়া ফেলেছে এই জুম শাড়িগুলো৷

ধুপিয়ান সিল্ক শাড়িঃ

ধুপিয়ান সিল্ক, নামের সাথেই বোঝা যায় সিল্ক এর একটি মিশ্রণ। এখানে কৃত্তিম একটি রেয়ন সুতা ব্যবহার করা হয় এবং সুতাগুলোতে মাড় এর পরিমাণ খুব কম থাকে তাই এই শাড়িগুলো অনেক সফট হয়। তবে এখানে যেহেতু কাউন্ট মেইনটেইন করা হয় তাই কিছু শাড়ি যেমন পাতলা, কিছু শাড়ি একটু ভারী ও হয়।

ধুপিয়ান এর মাঝে চেক খুব জনপ্রিয় একটি শাড়ি টাঙ্গাইল এর এবং এক রঙের ধুপিয়ান এ ব্লক, হ্যান্ডপেইন্ট, চুমকি র কাজ ও করা হয়ে থাকে। ধুপিয়ান শাড়িগুলো একটু সিল্কি এবং শাইনি, ম্যাটেরিয়াল ই এর প্রধান কারণ।

ঝর্ণা শাড়িঃ

টাঙ্গাইল এর শাড়ির কোয়ালিটি ডিপেন্ড করে এর শাড়ির সুতার বিভিন্ন প্রসেসিং এর উপর ও। ঝর্ণা শাড়ির সুতার প্রসেসিং টা ও ডিফারেন্ট এবং এতে কোন প্রকার মাড় দেয়া হয়না তাই খসখসে ভাব আসেনা এবং খুব সহজেই ম্যানেজাবল এ শাড়িগুলো৷

বুনন টা ই এমন যেন মনে হয় পাহাড়ি ঝর্ণা। যে রঙ এর ই শাড়ি হোক পাহাড়ি ঝর্ণার পানির মত সাদা সুতার এই কারুকাজ টা থাকেই, আর তাই এই শাড়ির নাম ঝর্ণা শাড়ি।

এক রঙ এর আধিক্য থাকলেও পাড় এ আলাদা হয়, শেড পরিবর্তন হয় পাড় এ এসেই সাথে আচল ও। ঝর্ণা শাড়ির মাঝেও রংধনু পাড় এর শাড়ি বুনেন টাঙ্গাইল এর তাঁতীরা, তাছাড়া জরির কাজ ও করা হয়, অনেক সময় জমিন এক রঙ এর আধিক্য না থেকে দুই রঙ উপর নীচে করা থাকে, এমন বিভিন্ন ধরণের ঝর্ণা শাড়ি হয় টাঙ্গাইল এ৷ শতভাগ সুতি  জন্য ফুলে থাকেনা শাড়িগুলো।

রংধনু শাড়িঃ

টাঙ্গাইল এর শাড়ির সবথেকে আকর্ষণীয় অংশ হলো এর পাড় ও আচল। এই অংশ দুটো নিয়ে নানান রকম ভাবনা চিন্তা করে থাকেন তাঁতীরা, সাথে ফুটিয়ে তোলেন বিভিন্ন সৌন্দর্য্যে। রংধনু শাড়ি ও তাঁতীদের দেয়া শাড়ির ভিন্নধর্মী একটি রূপ।

আকাশে রংধনু উঠলে কি দারুণভাবে রঙ এর একটি অবয়ব আমরা দেখতে পাই। এই প্যাটার্ন টি ফলো করা হয় এই শাড়িতে। পাড় ও আচলে রংধনুর মত করেই কয়েকটি রঙ কে একসাথে ফুটিয়ে তোলা হয়।

পিউর সুতি তে যেমন এই শাড়ি টি হয় তেমনি হাফসিল্ক এ ও এই শাড়ি তৈরি হয়নেক সময় এতে চুমকি সিকোয়েন্স ও করা থাকে। জুম শাড়িতে ও রংধনু পাড় লক্ষ্য করা যায়।  কাঁথা স্টীচ সেলাই এর মোটিভ এ ও কিছু রংধনু পাড় এর শাড়ি আছে।

অত্যন্ত সিম্পল কিন্তু দারুণ শাড়ি এগুলো। প্রাইস হরহানেশা কেনার উপযুক্ত জন্য শাড়িগুলোর চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলছে।

টাঙ্গাইল এর সিল্ক শাড়িঃ

সিল্ক আমাদের দেশের গর্ব৷ সিল্ক এমন একটি ম্যাটেরিয়াল যা প্রায় ৪০০০ বছর আগের এবং তা গৌরবের সাথে বিজনেস করে আসছে অনেক অনেক বছর ধরে৷ রাজা রাণী থেকে বিশিষ্ট মহলের সবাই ছিলো সিল্ক প্রেমী এবং সিল্ক এর পোশাক ছিলো অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও সব সমাজের লোকেদের  পরিধানের জন্য সামর্থ্যের মাঝে ছিলো ও না এটি। এর ইতিহাস মানেই নানা লুকোচুপি ও রহস্যময়।  টাঙ্গাইল এর তাঁতীদের ও সিল্ক নিয়ে জল্পনা কল্পনার শেষ নেই। খুব সহজলোভ্য সিল্ক থেকে শুরু করে প্রাকৃতিক সিল্ক ফাইবার এর শাড়ি ও তৈরি হয় এখানে। বিভিন্ন ধরণের সিল্ক থেকে বিভিন্ন উপায়ে এখানে শাড়ি প্রস্তুত  করা হয়। হাফসিল্ক যেমন খুব ই জনপ্রিয় পাশাপাশি টাঙ্গাইল এর সফট সিল্কগুলো ও অনেক জনপ্রিয় এর সফটনেস এর জন্যই। অনেকেই এই শাড়িকে প্রথম দেখেই এর ম্যাটেরিয়াল এর প্রেমে পরে যায়, যেমন সফট তেমনি এর কারুকাজ। বিভিন্ন রঙ এর মাঝে সুন্দর জরি সুতার করা পাড় এর সাথে থাকে দারুণ দারুণ মোটিভ এর আচল সাথে পুরো বড়িতে ছিটেফোটা কাজ।  সিল্ক এর মাঝে স্ট্রাইপ ডিজাইন ও টাঙ্গাইল এ বেশ চলমান এখন। সিল্ক এর শাড়িগুলো গায়ের সাথে মিলে থাকে এর মোলায়েম বৈশিষ্ট্যের জন্য। 

হাফসিল্ক, গ্যাস সিল্ক, সফট সিল্ক, এন্ডি সিল্ক, কাতান সিল্ক, বেনারসি সিল্ক, বলাকা সিল্ক,  তসর সিল্ক এমন অনেক ধরণের সিল্ক শাড়ি রয়েছে টাঙ্গাইল এ। যা আগে হাতের তাঁত এ বুনন হলেও এখন বেশিরভাগ ই মেশিন তাঁত এ বুনন করা হয়। কিছু কিছু সিল্ক অনেক বেশি শাইনি হয় এবং পার্টি বা প্রোগ্রাম এর জন্যই মূলত এই শাড়িগুলোকে নিজেদের উইশলিস্ট এ রাখা হয়৷

এসব ছাড়াও টাঙ্গাইল এ নানান ধরনের শাড়ি রয়েছে৷ টাঙ্গাইল এর তাঁতীদের ভাষায় মসলিন এর মত এক ধরনের থান ও আছে এখানে৷ আমরা জানি যে আসল সেই মসলিন হারিয়ে গেছে তবে, উন্নতমানের আধা রেশমি সুতাকে বিশেষ ভাবে প্রসেসিং করে  ও বুনন এর এক বিশেষ প্রক্রিয়া ফলো করে মসলিন প্যাটার্ন এর এই শাড়িগুলো তৈরি হয় টাঙ্গাইল এ। অনেক সময় পুরো শাড়ি জুড়ে তাঁত এ ই বুনন করা হয় বিভিন্ন ফুলেল ডিজাইন বা লতাপাতা।  এসব থানে করা হয় এমব্রয়ডারি ও।  অনেক সুন্দর এ শাড়িগুলো দেখলেই বোঝা যায় আমাদের তাঁত কত সমৃদ্ধ এবং আমাদের তাঁতীরা কতটা দক্ষতার সাথে এসব কাজ করে৷

মাদুরাই শাড়িঃ

মাদুরাই শাড়ি বলতেই ভারতীয় মাদুরাই কেই চিনি আমরা। ভারতের তামিল প্রদেশের প্রত্যন্ত এক গ্রাম মাদুরাই, সেখানকার ই প্রসিদ্ধ একটি হাতে বোনা শাড়ি মাদুরাই শাড়ি।  টাঙ্গাইল এর তাঁত এ ও মাদুরাই এর প্যাটার্ন এ শাড়ি তৈরি হয় এবং এগুলোকে টাঙ্গাইল এর মাদুরাই শাড়ি বলা হয়। মাদুরাই শাড়িগুলো এক সময় শুধু সাদা বা অফ-হোয়াইট হলেও এখন বিভিন্ন রঙ বেরং এর এর হয়।

চ্যাপ্টা জরি সুতার পাড়, পুরো জমিন জুড়ে স্কয়ার শেপ এর কোটা গুলোতেও জরি সুতার আস্তরণ এবং সামঞ্জস্যপূর্ণ আচল এ শাড়িগুলোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য৷

শাড়ির পাড় দুইপাশ থেকেই এমনভাবে তৈরি যাতে দুইপাড় কে নীচে রেখে বা উপরে রেখে দুইভাবেই পরা যায়, ইভেন মাদুরাই এর শেষের দিকেও আচলের মত অংশ থাকে, এর দলে আচল ও দুই রকম হয় দুই পাশে, অর্থাৎ একটি শাড়িকেই দুইটি শাড়ির মত করে পরা যায়৷ টাঙ্গাইল এ মাদুরাই বেশিরভাগ ই মেশিনে তৈরি হয় এর ফলে শাড়ির প্রাইস কমে আসে৷ পরতে সহজ, আরামদায়ক ও স্টাইলিশ এই শাড়িগুলোকে সাধ্যের মধ্যে পাওয়াতে দিন দিন জনপ্রিয়তা আকাশ ছুঁয়ে উঠছে এ শাড়ির।

পাটের শাড়িঃ

পাট আমাদের যেমন প্রপধান অর্থকারী ফসল তেমনি পাট এর তৈরি অনেক পণ্য ও আমাদের কে করেছে সমৃদ্ধ। পাট থেকে প্রাপ্ত ফাইবার এ অনেক ধরনের পণ্য হয়। তাঁত এ এই ফাইবার ব্যবহার করে শাড়ি ও তৈরি করা হয়। দক্ষ তাঁতীরা পাটের ফাইবার দিয়েও তাদের দক্ষতার নিদর্শন রেখেছেন পাটের শাড়িতে৷ টাঙ্গাইল এ দুই ধরণের তাঁত এর শাড়ি তৈরি হয়।

  • অরিজিনাল জুট দিয়ে তৈরি শাড়ি
  • আর্টিফিশিয়াল শাড়ি

অরিজিনাল পাটের শাড়ি, নামেই বুঝা যায় যে এখানে জুট এর মেইন ফাইবার দিয়েই প্রসেসিং করে কাজ করা হয়। এমন ও শাড়ি আছে যাতে জুট থেকে যে রশির মত পাওয়া যায় তা সরাসরি ব্যবহার করে পুরো শাড়িতে ও আচলে স্ট্রাইপ করা । কিছু পাটের শাড়িতে প্রাকৃতিক কিছু তন্তু ও মিক্সড থাকে।

আর্টিফিশিয়াল পাটের শাড়ি এমন হয় যে এর সাথে অন্যান্য সুতার সাথে প্রসেসিং করা থাকে৷ তা হতে পারে লিলেন বা জুট কটন বা জুট সিল্ক৷।

পাটের শাড়ি তৈরি হয় পিট লুম বা গর্ত তাঁত এ এবং পাওয়ারলুম এ৷ গর্ত তাঁত এর শাড়িগুলোর প্রাইস

অনেক বেশি হয়।

পাট থেকে পাওয়া ফাইবার এর প্রসেসিং সহ শাড়ি বুনন শেষ হতে প্রায় ২০-২৫ দিন সময় লেগে যায়৷ একটি শাড়ি তাঁত এ বুনতেই ২-৩ দিন সময় লাগে, এর মাঝেও যদি ডিজাইন অনেক ভারী হয় তবে তা ০-১২ দিন সময় ও লেগে যায়।

পাটের শাড়ি এক সময় পাট এর সুতার ফাইবার এর কালার গুলোতে বেশি থাকলেও এখন এখানেও এসেছে রঙ এর আধিক্য, বেজ কালার এর সাথে রঙ মিশিয়ে পরিবর্তন ও করা হয় সাথে সুতি বা হাফসিল্ক শাড়িগুলোতে ও স্ট্রাইপ হিসেবে বা বিভিন্ন ফুলেল ডিজাইন এ পাটের শাড়ি তৈরি হয়।

এখানেই শেষ নয় আসলে টাঙ্গাইল এ বিভিন্ন ডিজাইন এর উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন শাড়ির নাম দিয়ে থাকেন তাঁতীরা যেহেতু পাড় এর ডিজাইন এ সেরা টাঙ্গাইল তাই পাড় এ যে ডিজাইন করা হয় তার নামেও অনেক শাড়ির নাম আছে। যেমনঃ  যোগ যে চিহ্ন সেই প্রতীক এর যে শাড়ি তা প্লাস পাড়, দাবার কোট ও আঁকেন তাঁতীরা যার নাম দাবাকোট পাড়, জবা ফুলের জবা পাড়, কলকা পাড় , মাধবীলতা, বেলী ফুল এমন বিভিন্ন কিছু। এক ধরণের শাড়ি আছে যার পাড় এর ডিজাইন এত চ্যাপ্টা যে হাটু পর্যন্ত উঠে যায় তাই এই শাড়িগুলোকে হাটুপাড় শাড়ি বলা হয়। এইসব শাড়িগুলোই যেমন সুতিতে হয় তেমনি গ্রাহক চাহিদায় হাফসিল্ক মোটিভ এ ও হয়। টাঙ্গাইল এর মধুপুর উপজেলায় রয়েছে গারো উপজাতিদের বাস। এরা নিজেরাই আগে থেকেই তাদের প্রয়োজনীয় বস্ত্র নিজেরা তৈরি করে তাদের তাঁত এ, অবশ্য নিজেদের প্রয়োজনের বাহিরে বাণিজ্যিক ভাবেও তারা পোশাক তৈরি করে এবং তা বাজারজাত ও করে৷ তাদের ওখানে এসব কেনাবেচার বাজার ও আছে। এই গারো রা দকশাড়ি ও বুনে থাকে৷  শাড়ির বর্ণনায় টাঙ্গাইল জেলার শাড়ির নাম এজন্যই এতটা এগিয়ে যেখানে প্রয়োজন কে মাথায় রেখে শাড়ি তৈরি হচ্ছে প্রতিনিয়ত।

সারাবিশ্বে টাঙ্গাইল শাড়ির সুনাম অক্ষুন্ন রয়েছে সেই যুগ যুগ ধরেই। অনেক আগে যেমন এখানকার তাঁতীদের হাতে বোনা শাড়ি নিয়ে বাণিজ্য ছিলো রমরমা। এলাসীন ঘাটকে কেন্দ্র করে এখানকার বসাকরা গড়ে তুলে তুলেছিলেন টাঙ্গাইল শাড়ির বাণিজ্য, ইউরোপে পাড়ি জমাতো তখন।  এখন এতটা না হলেও রপ্তানির ধারাবাহিকতা আছেই।

উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী প্রতি সপ্তাহে ভারতেই শাড়ি রপ্তানি হয় ৫০০০০। টাঙ্গাইল এ তাঁতী মহাজন দের সাথে কথা বলেও জানা যায় যে টাঙ্গাইল এর শাড়ির অনেক ক্রেতা আছে যারা বাহির থেকে বা ভারত থেকে শাড়ি কিনতে আসেন হাটগুলোতে বা পাথ্রাইল সহ অন্যান্য জায়গাগুলোতে যেখানে শাড়ি কেনাবেচা হয়। টাঙ্গাইল এর করোটিয়া হাট বা শাড়ির রাজধানী হিসেবে খ্যাত পাথ্রাইল বাজারে হাজার হাজার শাড়ি কেনাবেচা হয় প্রতি সপ্তাহে।

টাঙ্গাইল এর শাড়ির বাজার শুধু ভারতে না বরং অন্যান্য অনেক দেশে এর জনপ্রিয়তা রয়েছে ও রপ্তানি হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, অংল্যান্ড, ইতালি, অস্ট্রেলিয়া,  কানাডা, মালয়েশিয়া, ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে টাঙ্গাইল এর শাড়ি রপ্তানি হয়।

টাঙ্গাইল এর শাড়ি আমাদের গৌরব। সুতি শাড়ি প্রসিদ্ধ হলেও এখানে এত ভ্যারাইটি র শাড়ি আছে যে যত জানার চেষ্টা করি ততটা ই অবাক হতে হয়। টাঙ্গাইল শাড়ির এই যে এত নাম ডাক এর পিছনে আরেকটি কারণ আছে তা হলো এর প্রাইস রেঞ্জ। একেবারে নিম্ন আয়ের মানুষ থেকে শুরু করে উচ্চবিত্তদের জন্য ব্যবহারউপযোগী ও দামে মানানসই শাড়ি এখানে পাওয়া যায়। সব সময় এভেইলাবল সুতি, হাফসিল্ক যেমন আছে মাসের পর মাস সময় দিয়ে বুনতে হয় বা এক শাড়ি বুনতেই বছর পাড় হয়ে যায় এমন শাড়িও আছে৷

আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা র গায়ে ও শোভা পেয়েছে টাঙ্গাইল এর তাঁত এর শাড়ি৷ প্রধানমন্ত্রী সেই শাড়ি পরে সংসদে ও বসেছিলেন এবং তিনি শাড়ির বুনন ও মান এ এতটাই সন্তুষ্ট ছিলেন যে শাড়ির কারিগর কে পুরস্কৃত ও করেন।  আর এর পর কারিগর এত অনুপ্রানিত হয়েছিলেন যে প্রধানমন্ত্রীর একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের যে বেসিক থিম সেটি দিয়েও পরবর্তীতে শাড়ি তৈরি করেন যাতে ১০-১৫ রঙ এর র সিল্ক সুতা দিয়ে কাজ করা হয়েছিলো৷ অনেক বেশ প্রশংসা ও কুড়িয়েছিলো সেই শাড়িটি৷

সারাদেশে যেমন পৌঁছে যায় তাঁত এর শাড়ি টাঙ্গাইল থেকে, তেমনি দেশের নামী দামী ব্রান্ড এর শাড়ি ও তৈরি হয় এখানে  যারা নিজেরা ডিজাইন করে শাড়ি বানিয়ে নেয় তাঁতোদের কাছে। তবে শুধুমাত্র বিক্রির উদ্দেশ্য না হয় প্রচারণার মাধ্যমে ডিজাইনার শাড়িগুলো এবং তাদের ম্যাটেরিয়াল সম্পর্কে তুলে ধরতে পারলে টাঙ্গাইল এর তাঁত এর শাড়ি অন্যরকম মাত্রা পাবে এবং জনগণের মাঝে তাঁত এর শাড়ি নিয়ে আরো সচেতনতা বাড়বে। 

টাঙ্গাইল এ তাঁতীদের সাথে কথা বললে তাদের মুখে তাদের অসহায় অবস্থার কথা বর্ণনা পাওয়া যায়, সারাদিন কাজ করেও পারিশ্রমিক এর ঘাটতি টা থেকেই যায়, আবার মহাজন বা কারখানার মালিক রা ও কাঁচামাল এর দাম বৃদ্ধি, পর্যাপ্ত ঋণ না পাওয়া, তাঁতীদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য কোন পদক্ষেপ বা ট্রেইনিং এর সুবিধা কম এসব অনেক কিছু তুলে ধরেন। সংশ্লিষ্ট মহল এগিয়ে এলে তাঁত এর মত সম্ভাবনাময় এই সেকটর টা কে আরো অনেক বেশি এগিয়ে নিয়ে যাওয়া শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা।

ই-কমার্স এ এখন বহুলভাবে কেনা-বেচা হচ্ছে তাঁত এর শাড়ি, তাই সামনের দিনগুলোতে অবশ্যই তাঁতশিল্পের হারানো সেই যে গৌরব, সুনাম সব ফিরে আসবে ইন শা আল্লাহ৷ জনসচেতনতা বাড়ছে, পরিবেশবান্ধব তাঁতের শাড়িতে আকৃষ্ট ও হচ্ছে এখনকার সচেতন গ্রাহক তাই প্রচারণা কে হাতিয়ার হিসেবে নিয়ে টাঙ্গাইল এর তাঁত কে তুলে ধরার চেষ্টা করে যেতে হবে, তবেই আমরা পাবো টাঙ্গাইল এর শাড়ির যথাযোগ্য সন্মান এবং তাঁতীরা পাবে উপযুক্ত পারিশ্রমিক ও উদবুগ্ধ হবে নতুন নতুন শাড়ি তৈরিতে।

টাঙ্গাইল তাঁত এ এখানে উল্লিখিত ছাড়াও আরো অনেক অনেক ধরণের শাড়ি আছে যা নিয়ে তথ্য উপাত্ত কম। আমরা নিজেরা কিছু মানুষ ও যখন এই সেকটর গুলোকে তুলে ধরার চেষ্টা করবো তখন হয়তো ইন্টারনেট বা সব জায়গায় অনেক বেশি ধরনের শাড়ি সম্পর্কে তথ্য দিতে পারবো এবং এগুলো আমাদের জন্য অনেক পজিটিভিটি বয়ে আনবে। কেননা সারাবিশ্বে টাঙ্গাইল শাড়ি নিয়ে সুনাম আছে অথচ টাঙ্গাইল।শাড়ি নিয়ে ইনফরমেশন গ্যাপ আছে জন্য বিদেশের মাটিতে বসে এসব শাড়ি নিয়ে জানা বা কাজ করা হয়ে উঠেনা। এই দিক থেকে আমরা যদি এগিয়ে আসি তবে খুব ভালো কিছু অবশ্যই হবে এবং আমাদের তাঁতের শাড়ির বাণিজ্য হয়ে উঠবে আবারও রমরমা।

লেখিকাঃ

Rockshana Akter Popy

4 thoughts on “টাঙ্গাইলের শাড়ি”

  1. ভারত যে এ শাড়ির জিআই ট্যাগ নিয়ে নিয়েছে তা জানেন? মানে রেখে ঢেকেও চুরি করেনি। ডিরেক্ট টাঙ্গাইল শাড়ি নামেই জিআই ট্যাগ নিয়েছে।

  2. Rahanur Ferdousi

    শাড়ির সাথে যে আমাদের দেশের শিল্প ও সম্পদের যোগ আছে তা এই লেখায় ফুটে উঠেছে। বিস্তারিত তথ্য সমৃদ্ধ অসাধারণ লেখা বাংলাদেশের তাঁত শিল্প ও শাড়ি নিয়ে। ধন্যবাদ আপু, একসাথে সবগুলো তথ্য দেওয়ার জন্য।

  3. অসাধারণ অসাধারণ
    পপি আপুর মাধ্যমে আমাদের টাংগাইলের ঐতিহ্যবাহী শাড়ি নিয়ে দেশ ও দেশের বাইরের মানুষ জানার সুযোগ পাচ্ছে।
    শাড়ির আদ‍্যপ্রান্ত জেনে খুব ভালো লাগছে আপু।
    আপনার অনেক পরিশ্রমের ফলে আমরা এত তথ্য জানার সুযোগ পাচ্ছি।
    ধন্যবাদ আপি

Write your comment

Scroll to Top