সিলেটের জুম শাড়ি

বাংলাদেশের ষড়ঋতু-র আবহাওয়ায় ব্যবহার উপযোগী আরামদায়ক শাড়ির অন্যতম একটি পাহাড়িদের জুম শাড়ি। মূলত পাহাড়ে বসবাসকারী আদিবাসীদের তাঁতে বোনা সিলেটের ঐতিহ্যবাহী শাড়ি হচ্ছে জুম শাড়ি। সাধারনত লিলেন ও সিল্ক সুতার মিশ্রনে তৈরি হওয়া জুম শাড়ির জমিন অত্যন্ত হালকা ও নরম হয়ে থাকে। দেখতে অনেকটা সিল্ক শাড়ির মতো হলেও জুম শাড়ি লিলেনের মতোই আরামদায়ক । অনেকেই মসলিন শাড়ির সাথেও এর তুলনা করে থাকেন। জুম শাড়ি পুরো উজ্জ্বল এক রঙের হলেও আচঁলের কিছু অংশে জড়ি সুতার টানা দেয়া থাকে।

মূলত সাশ্রয়ী মূল্য ও ব্যবহারের সুবিধার্থে জুম শাড়ি তরুনী ও পেশাজীবী নারীদের মাঝে পছন্দের শীর্ষে অবস্থান করে। তাছাড়াও হ্যান্ডলুমে হালকা সুতোয় বোনা টেকসই জুম শাড়িগুলো ক্যাজুয়াল হোক বা ট্র্যাডিশনাল ওয়্যার যে কোন উৎসবে এলিগেন্ট লুক এনে দেয়। ফলে যে কোন আবহাওয়ায় ফ্যাশন সচেতন রমনীদের কাছে দারুন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে দেশীয় একরঙা জুম শাড়ি।

অনেকে ক্রেতারা ভুল ধারনা করেন যে ‘মৈরাং পাড়’ মোটিফের জুম শাড়িগুলোও জুম শাড়ি যেহেতু নামে জুম শাড়ি যুক্ত রয়েছে। কিন্তু এই শাড়িগুলোর কোয়ালিটির সাথে জুম শাড়ির কোন মিল নেই। সম্পূর্ণ আলাদা কোয়ালিটির শাড়ি হচ্চে জুম শাড়ী

জুম শাড়ি দেখতে পাতলা নেটের মতো হওয়ায় অনেকে একে মোটা কোটা শাড়ি বলেন। শাড়ির বুননটা একটু ফাঁকা ফাঁকা হয় বলে শাড়িটি নেটের মত দেখালেও অরজিনাল জুম শাড়ি ফ্যালফ্যলে হবে না বা কুচকে থাকবে না কোথাও। বরং সুতার কারনে আলো পড়লে শাড়িটি চিক-চিকে উজ্জ্বল দেখাবে। জুম শাড়ির পাড়টা জমিনের তুলনায় অনেক সফট এবং বেশ পুরু হবে ৪ ইঞ্চির মতো। আঁচলেও দেয়া থাকবে সোনালি জরির স্কাইপ ও টারসেল।

দেশীয় হ্যান্ডলুম তাঁতে তৈরি হলেও জুম শাড়ির মূল কাঁচামাল সুতা কিন্তু পুরোপুরী আমদানী নির্ভর। এমনকি মনিপুরীদের তাঁতে তৈরি জুম শাড়ির সুতাও আমদানী করা হয় কোরিয়া থেকে। স্থানীয় তাঁতীরা জুম শাড়ি বুনতে যে ধরনের সুতো ব্যবহার করে তা মূলত কৃত্রিম সিল্ক বা রেয়ন (যা ভিসকোস সুতো হিসেবে পরিচিত) এবং লিলেন সুতোর মিশ্রণে তৈরি। সুতা আমদানী নির্ভর হলেও জুম শাড়ি বেশ সাশ্রয়ী মুল্যে পাওয়া যায় তাঁতিদের কাছ থেকে। 

জুম শাড়ির সুতার মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই সুতাগুলো হাত দিয়ে ঘসলে ঠাণ্ডা অনুভুতি হয়। ফলে জুম শাড়িতে গরম অনুভূত হয়না। গ্রীষ্মের গরমেও এই শাড়ি ব্যবহারে অত্যন্ত আরামদায়ক হয়ে থাকে। হালকা-গাঢ় টেকসই রঙের জুম শাড়িগুলো তাই যেকোনো ঋতুর জন্যই মানানসই ও আরামদায়ক। অন্যদিকে এই শাড়িগুলো যেমন চট করে পরে নেওয়া যায় তেমনি খুব সহজেই সামলানোও যায়। ফলে সব-বয়সী নারীরাই এটি স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে পরতে পারেন।

ধারনা করা হয় পাহাড়িদের ‘জুম চাষ’ থেকে জুম শাড়ির নামটা এসেছে। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের সর্ববৃহৎ চাকমা আদিবাসি গোষ্ঠী তাদের পরিধেয় পোশাক নিজেরা তৈরি করে থাকেন। তাদের প্রত্যেকের ঘরেই নিজস্ব তাঁত ও চরকা রয়েছে। যার মাধ্যমে তারা অত্যন্ত চমৎকার পোশাক তৈরি করে থাকেন। তাদের পোশাক তৈরির মূল কাঁচামাল তুলা ও রং সাধারণত জুম ক্ষেতের উৎপাদিত তুলা ও বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপাদান থেকে সংগ্রহ করা হতো। যদিও বর্তমানে জুম শাড়ির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত রং ও সুতা বাজার থেকেই কেনা হয়।

জুম মূলত ছোট ওড়নার মত দুই টুকরা কাপড়। পাহাড়ি আধিবাসী মেয়েদের ওড়নার মতো একটা পোশাককে মোডিফাইড করেই এই শাড়ি বানানো হয়েছে। শুরুতে শ্রীমঙ্গলের চাকমা ও মনিপুরি তাঁতিরা জুম শাড়ি তৈরি শুরু করেন। পরবর্তীতে বান্দরবনের তাঁতিরা এবং খাগড়াছড়ির তাঁতিরাও জুম শাড়ি বুনতে থাকেন। একসময় দেশব্যাপী নারীদের মাঝে জুম শাড়ির জনপ্রিয় হতে থাকে। তাই চাহিদা বৃদ্ধির করা মাথায় রেখে পরবর্তীতে টাঙ্গাইলের তাঁতিরাও জুম শাড়ি বুনতে করতে শুরু করেন। বর্তমানে তাঁতের শাড়ির পাশাপাশি টাঙ্গাইলের জুম শাড়িও বেশ জনপ্রিয়।

যদিও বর্তমান সময়ে আমরা জেনেছি যে মানিকগঞ্জের তাঁতপল্লীতেও বাহারী জুম শাড়ি উৎপাদন করছেন স্থানীয় তাঁতিরা।

জুম শাড়িগুলো যেহেতু খুব পাতলা হয়ে থাকে তাই এই শাড়ি সংরক্ষণ ও পরিষ্কার করার ক্ষেত্রে কিছু সাবধানতা অবলম্বন করা গেলে শাড়িগুলো দীর্ঘকাল ভালো ও সুন্দর থাকবে। এই শাড়ি ধোয়ার ক্ষেত্রে ড্রাইওয়াস করা উত্তম। হাতে পরিষ্কার করতে হলে ক্ষার মুক্ত ডিটারজেন্ট অথবা শ্যাম্পু দিয়ে ওয়াস করা উচিত। অন্যদিকে রোদে শুকানোর ক্ষেত্রেও উলটোপিঠে শুকানো উচিত এতে করে শাড়ির রং টেকশই হবে।

তবে অনেক ক্রেতারাই এই সম্পর্কে তেমন জানেন না। তবে সাম্প্রতিক সময়ের ই-কমার্স উদ্দ্যোগের ফলে জুম শাড়ি সম্পর্কে জানতে পারছেন। এখন বরং জুম শাড়ি সম্পর্কে জানেন না এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া কঠিন। বলতেই হবে এই পরিবর্তনের কারন অনলাইন প্রচার-প্রচারণা। ফলে পাহাড়ি ঐতিহ্যের জুম শাড়ির চাহিদা ও বাজারও বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে বর্তমান সময়ে। 

লেখিকাঃ

Amrita Rani Deb

Write your comment

Scroll to Top