পাবনা তাঁতের শাড়ি

তাঁত শিল্প আমাদের দেশীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অংশ যা মূলত আমাদের প্রাচীন ও প্রাগৈতিহাসিক শিল্পকে প্রতিনিধিত্ব করে। দেশের বৃহত্তর হস্তচালিত তাঁত শিল্পের একটি বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে পাবনা ও সিরাজগঞ্জের সুখ্যাতি। মূলত টাঙ্গাইল তাঁত শিল্পের পর তাঁতের শাড়ির জন্য পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলা বিখ্যাত।

সাম্প্রতিক সময়ের কিছু জরিপ থেকে জানা যায় যে, পাবনা জেলার তাঁতশিল্পের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জরিয়ে আছে স্থানীয় প্রায় ১৫ লাখ মানুষের জীবন ও জীবিকা। এখানে তৈরি শাড়ি গুলো ‘পাবনা শাড়ি’ নামে দেশব্যাপী পরিচিত। ঐতিহ্যবাহী পাবনা জেলার অস্তিত্বের সাথে মিশে আছে ‘পাবনা শাড়ি’র নাম।

মূলত পাবনা ও সিরাজগঞ্জের গ্রামীন কৃষি সহ অন্যান্য ক্ষুদ্রশিল্প ভিত্তিক জনগোষ্ঠীতে তাঁত শিল্পের প্রভাব ব্যাপক। যুগ যুগ ধরে এসব জেলার তাঁতিরা পুর্বপুরুষদের শিল্পমান ধরে রেখে কাজ করে যাচ্ছেন। ফলে অর্থনীতিতে বিশেষ অবদান রেখে আসছে এই হস্তচালিত তাঁত শিল্প। তাঁত শিল্পে নারী কর্মসংস্থান বৃদ্ধি জেলার অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে উল্লেখ্যযোগ্য অবদান রাখছে। 

বহু যুগ ধরেই পাবনা জেলা তাঁতবস্ত্রের জন্য বিখ্যাত। পাবনার সুজানগরে একসময় মসলিন শাড়ি তৈরি হতো। তবে বর্তমানে মসলিন বিলুপ্ত হলেও পাবনার তাঁতবস্ত্র আজও দেশে ও দেশের বাইরে ব্যাপক জনপ্রিয়। পাবনা শাড়ি ছাড়াও এখানে অন্যান্য শাড়ি-কাপড়, লুঙ্গি, চাঁদর, গামছা এখনো তৈরি হয়।

‘পাবনা শাড়ি’ মূলত স্থানীয় মুসলমান তাঁতিরা তৈরি করে আসছে। তবে এখানকার বেশিরভাগ তাঁতবস্ত্র তৈরি হচ্ছে পাওয়ারলুমে। হস্তচালিত তাঁতের সংখ্যা দিন দিন কমে আসছে। পাবনা জেলা শহর সংলগ্ন দোগাছী, শিবরামপুর, ভাঁড়ারা, জালালপুর, নতুনপাড়া, গঙ্গারামপুর, বলরামপুর, মালঞ্চি, কুলুনিয়া, ছোন্দহ, ছেচানিয়া, জোড়গাছা, সোনতলা, কাশিনাথপুর, বেড়া উপজেলার কৈটলা, পাটগাড়ীসহ বেশকিছু এলাকায় এখনো হস্তচালিত তাঁতশিল্প টিকে আছে।  

এই শাড়িগুলোতে টাঙ্গাইলের শাড়ির তুলনায় নকশার পরিমান কম থাকে বিধান দামেও সাশ্রয়ী হয়ে থাকে। তবে নমনীয়তা ও টেকসই রঙের জন্য বাঙালী নারীরা শত বছর ধরে সাচ্ছন্দের সাথে গায়ে জরিয়ে আসছে পাবনা শাড়ি।

‘ওলো করিস না তুই মন ভারী,

পাবনা থ্যাইকা আইন্যা দিমু ট্যাহা দামের শাড়ী।’

পাবনার চারণ কবির মুখে এখনো শোনা যায় অভিমানী বধূর মানভাঙ্গার গান। পাবনার গ্রামীন সংস্কৃতিতে এমন পুংতি গুলোই জানিয়ে দেয় পাবনা শাড়ি নারীর আবেগ অনুভুতিতে কতটা জড়িয়ে আছে।

পাবনা শাড়ির সুনাম দেশে বিদেশে ছড়িয়েছে প্রায় শতবর্ষ আগেই। বিশেষ করে ইদ, পুজা ও বাঙালীর বিভিন্ন উৎসব-পার্বনকে কেন্দ্র করে বেড়ে যায় পাবনা তাঁতের শাড়ির চাহিদা। জামদানি, সুতি জামদানী, সুতি, কাতান, চোষা, বেনারসি, শেট সহ বিভিন্ন নামে ও নকশার শাড়ি তৈরি হচ্ছে এই পাবনার তাঁতপল্লীতে। ফলে যুগপোযোগী বুনন শৈলী আর রঙের মাধুর্যে বোনা পাবনা তাঁতের শাড়ির খ্যাতি ছড়িয়েছে দেশে-বিদেশে।

পাবনা তাঁতের শাড়ির বুনন প্রক্রিয়াঃ

পাবনা তাঁতের শাড়ি পুর্বে পারিবারিক তাঁত কুটিরগুলোতে তৈরি হলেও বর্তমানে এই চিত্রে ভিন্নতা এসেছে। এখন ছোট-বড় অনেক তাঁত কারখানা গড়ে উঠেছে যেখানে স্থানীয় তাঁত পরিবারের সদস্য সহ সহযোগীরা শ্রমের সবটুকু নিংড়ে দিচ্ছে তাঁত বুননে যাতে বছর জুড়ে সংসার খরচ জোগাতে পারে।

পাবনার তাঁতপল্লীর কুটিরের চিত্র বাংলার অন্যান্য তাঁতপল্লীর মতোই। খট খট শব্দে চলছে ক্রমাগত, তাঁতের ওঠানামায় বুনন হচ্ছে শত আবেগে জরিয়ে থাকা পাবনা তাঁতের শাড়িগুলো। পরিবারের পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও ব্যস্ত সুতা কাটায়। আবার কেউ ব্যস্ত সানা বাধায়, সুতা রং করায় বা শুকাতে। তাঁতে বুনন প্রক্রিয়ার শেষেও শাড়িতে যোগ হয় নান্দনিক সব শিল্পকর্ম। ব্লক, বর্নিল সুতার নকশী কাজ বা রং তুলির ছোঁয়া যেন শাড়িতে ফুটিয়ে তোলে অমলিন সৌন্দর্য।

পাবনা শাড়ি তৈরিতে রয়েছে অনেকগুলো ধাপ। প্রথমে শাড়ি তৈরির জন্য সুতা সংগ্রহ করা এবং তাতে মসৃণ করে রং করে নিতে হয়। তারপর যে নকশাটি শাড়িতে ফুটিয়ে তোলা হবে তা নির্ধারন প্রক্রিয়া। সেটিকে গ্রাফ কাগজে এঁকে তা থেকে ট্রেসিং বের করে নিয়ে সে নকশা অনুযায়ী সুতা সাজিয়ে মাকুতে ভরে নিয়ে শুরু হবে শাড়ি বোনার কাজ।

প্রতিটা ধাপেই তাঁতিরা কাজ করেন অত্যন্ত নিখুত দক্ষতার সাথে। তবে বর্তমান সময়ে আধুনিকায়ন ও প্রযুক্তির ব্যবহারে চাহিদার পরিবর্তনের সাথে সাথে শাড়ি তৈরির পদ্ধতিতে এসেছে বেশ পরিবর্তন। মাকুর ব্যবহার থেকে শুরু করে, সুতা তৈরি ও শাড়ি রং করা বা শাড়ি বুননের কাজগুলো করতে তাঁতিরা দক্ষতা অনুয়ায়ী দলভেদে কাজ করেন। আগে হাতের সাহায্যে কাচা রং করা হলেও আজকাল সুতার রাঙাতে ব্যবহার হচ্ছে মেশিনের। এছাড়া মাকুতে যুক্ত হয়েছে আধুনিক যন্ত্রাংশ। ফলে বর্তমান সময়ের তাঁতিদের কাজ কিছুটা সহজ হয়েছে। যদিও নকশা অনুয়ায়ী এখনো এক একটি শাড়ি বুনতে এক থেকে দুইদিন সময় লেগে যায়। এমনকি বিশেষ কিছু নকশায় একজন তাঁতির এক মাসের শ্রমও লাগতে পারে। তবে এমন বৈচিত্র্যমন নকশায় তাঁতির শাড়ি বোনা শুরু হয় মূলত বিশ শতকের প্রথমার্ধে ডবি ও জ্যাকার্ড মেশিন প্রচলনের পর থেকেই।  

বর্তমানে পাবনা জেলার তিন ধরনের তাঁতে শাড়ি বুনা হয়। পাওয়ারলুম, পিটলুম এবং চিত্তরঞ্জন। শুধুমাত্র পাবনা সদরে ২০ হাজারেরও বেশি তাঁতি এই শিল্পের সাথে জড়িত। মূলত পাবনা সদরের দোগাছি, ভাড়ারা, জালালপুর, নতুনপাড়া, গঙ্গারামপুর, বলরামপুর, মালঞ্চি, কুলুনিয়া, খন্দকারপাড়া, কারিগরপাড়া, সাঁথিয়া উপজেলার ছোন্দহ, ছেচানিয়া, জোড়গাছা, সনতলা, কাশিনাথপুর, বেড়া উপজেলার কৈটলা, পাটগাড়ীসহ বিভিন্ন এলাকা তাঁতপল্লী হিসেবে প্রসিদ্ধ। পাবনা জেলার প্রায় নয়টি উপজেলাতেই রয়েছে তাঁতশিল্প। এর ভেতর সাঁথিয়া ও বেড়া উপজেলায় রয়েছে সবচেয়ে বেশি তাঁত। ফলে সাঁথিয়ায় পাবনার তাঁতের উন্নয়ন ও বিকাশের লক্ষ্যে তাঁত বোর্ড স্থাপন করা হয়েছে।

সে লক্ষ্যেই পাবনার দোগাছি ও ভাড়ারার স্থানীয় তাতীরা দেশীয় তাঁতের সাথে অন্যান্য নান্দনীক শিল্পকর্মের মিশ্রনে শাড়িতে নতুনত্ব নিয়ে এসেছে। যার ফলে পাবনা শাড়ির হাল ফ্যাশনের চিত্র দ্রুত পাল্টাতে শুরু করেছে। শাড়িকে আরো আকর্ষণীয় করতে শাড়ির বৈশিষ্ট্যের সাথে সমন্বয়ে রাখা হচ্ছে বিশেষ সব নাম। ফলে দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পরছে এখানকার শাড়ির সুনাম এবং দিন দিন চাহিদা বাড়ছে পাবনা তাঁতের শাড়ির। 

পাবনার বাহারী রং ও ডিজাইনের শাড়িগুলোর বিদেশেও মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ভারত, আমেরিকা, কানাডা, শ্রীলংকা, মালদ্বীপসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে রপ্তানি হচ্ছে এই শাড়ি। মূলত প্রবাসী বাঙ্গালীদের কাছে বেশ জনপ্রিয়তা রয়েছে পাবনার শাড়ির। দেশিয় বুটিক হাউজ কে-ক্রাফট-প্রতিনিধি হিসেবে কানাডা, আমেরিকা এবং নগরদোলা বুটিক হাউজ ইংল্যান্ডে রপ্তানী করছেন পাবনা শাড়ি। এছাড়াও ভারতের দিল্লি, বারাসাত, হুগলি, কলকাতা, শুভরাজ, গঙ্গা, রামপুর, পাটনাসহ অনেক বড় বড় শহরে পাবনা শাড়ি পাঠাচ্ছে তাঁতিরা। তাঁতিদের জানিয়েছেন, এসব অঞ্চলে পাবনা শাড়ির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।   

বাংলাদেশের সর্বশেষ তাঁতশুমারী সূত্রে জানা যায়, পাবনা জেলায় মোট ১৮ হাজার ৫৭৩টি তাঁত রয়েছে, যার মধ্যে চালু আছে ১৪ হাজার ৭৯৫টি। এছাড়াও জেলার দোগাছি, ভাড়ারা, জালালপুর, নতুনপাড়া, গঙ্গারামপুর, বলরামপুর, মালঞ্চি, কুলুনিয়া, খন্দকারপাড়া, কারিগরপাড়া, ছোন্দহ, ছেচানিয়া, জোড়গাছা, সনতলা, কাশিনাথপুর, বেড়া, কৈটলা, পাটগাড়ীসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ৫০ হাজার তাঁত পুনরায় চালু হয়েছে। এতদিন এসব তাঁত বন্ধ থাকলেও ইদ, পুজা সহ বিভিন্ন আনন্দ-উৎসব উপলক্ষ্যে পাবনা তাঁতের শাড়ীর বাজার চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে ফলে তাঁতিরা পুনরায় সচল করছে তাঁতগুলো। তবে স্থানীয় শিল্প সংশ্লিষ্টদের অনেকের ধারনা ১০ বছর আগের করা তাঁতশুমারী জরিপ থেকেও বর্তমান পাবনার তাঁতপল্লী প্রায় দ্বিগুণ আকার ধারন করেছে। সেই সাথে বেড়েছে তাঁতিদের সংখ্যাও।

তবে সাম্প্রতিক সময়ের সুতা, রং সহ তাঁত সামগ্রীর দাম বাড়ায় অনেক তাঁতিই তাঁত বন্ধ রাখার কথা জানিয়েছেন। তাঁতিদের দাবি, রং ও সুতার দাম দ্বিগুণ হলেও কাপড়ের দাম বাড়েনি। ফলে তাঁতিদের মোটা অঙ্কের ঋনের বোঝা মাথায় চেপেছে। ফলে বাধ্য হয়ে তাঁত বন্ধ করার কথা ভাবছেন তাঁতিরা।

দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ব্যবসায়ীরা পাবনা ও সিরাজগঞ্জের কাপড় কিনতে স্থানীয় হাটগুলোতে আসে। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের প্রধান দুটি কাপড়ে হাট পাবনার আতাইকুলা ও সিরাজগঞ্জের শাহজাদলুর। এছাড়াও পাবনার বনগ্রাম, রাকশা এবং সিরাজগঞ্জের সোহাগপুর হাটেও তাঁতিরা পাইকারীভাবে কাপড় বিক্রি করে থাকেন।

পাবনার তাঁত শিল্পের ঐতিহ্যঃ

খ্রিস্টাব্দ-পূর্ব কাল থেকেই এদেশে বস্ত্রশিল্পের সুনাম রয়েছে ফলে বিভিন্ন সময়ে লেখা প্রাচীন গ্রন্থেও এদেশের তাঁতশিল্পের প্রশংসামূলক বিবরনী খুঁজে পাওয়া যায়। রিয়াজুস সালাতিন গ্রন্থে (গোলাম হোসাইন সলিম, ১৭৮৮) সাদুল্লাপুর, নিশ্চিন্তপুর, আমিনপুর জেলায় বিখ্যাত ‘পাবনাই পাড়’ কাপড় তৈরির কথা উল্লেখ রয়েছে।

পাবনার গ্রামীন সংস্কৃতির নিজস্ব ঐতিহ্য এই তাঁত শিল্প। মুগল আমল থেকেই পাবনার তাঁত শিল্পের সাথে জড়িত ছিলো হিন্দু-মুসলিম উভয় ধর্মানুসারী তাঁতিরা। মূলত স্থানীয় উর্বর জমিতে চাষ করা তুলা থেকেই তাঁতের প্রধান কাঁচামাল তুলা সংগ্রহ হতো। আর এখানকার তুলা গুনে মানেও ছিলো সেরা। ফলে স্বদেশী আন্দোলনের প্রভাবে এখানকার তুলা উৎপাদনের পরিমান আরো বৃদ্ধি পেয়েছিলো। ১৯২৩ সালে এখানে প্রায় সাড়ে নয় হাজার তাঁত ছিল বলে বিভিন্ন নথী থেকে জানা যায়। পরবর্তীতে ১৯৪৭ এর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেও থেমে থাকেনি এখানকার তাঁত শিল্পের গতিধারা। তবে দেশভাগ সহ বিভিন্ন কারনে বদলে যায় তাঁত শিল্পের চেহারা। অনেক দক্ষ কারিগর সহ তাঁতিরা দেশ ত্যাগ করে চলে জান ওপার বাংলায়। ফলে বস্ত্র শিল্পের সাফল্য তখন অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রতিযোগিতা মূলক বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার মধ্যে পরে।

১৯৫৬ সালের করা সরকারী জরিপ থেকে জানা যায়, তৎকালীন সময়ে পাবনার তাঁতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ৪২ হাজার। একইভাবে ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ১৯৭৮ সালের হ্যন্ডলুম সেন্সারের তথ্য বলছে, তৎকালীন সময়ে পাবনার প্রায় লক্ষাধিক কারিগর সহ ৮৬ হাজার তাঁত ছিল যার মধ্যে ৩০ হাজার তাঁত ছিল বন্ধ।

লেখিকাঃ

Similar Posts

One Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *